হায়দরাবাদ : এবছর পদ্ম সম্মান প্রাপকের তালিকায় রয়েছেন ৩৩ জন মহিলা । যাঁরা নিজক্ষেত্রে উজ্জ্বল অবদান রেখেছেন । আর কয়েক দিন পরই আন্তর্জাতিক নারী দিবস । তার আগে মহিলা ওই পদ্মপ্রাপকদের স্মরণ করা । এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সুষমা স্বরাজ ।
সুষমা স্বরাজ । নামটাই যেন নিজে থেকে তাঁর একটি ছবি এঁকে দেয় । এমন একজন মহিলার ছবি যাঁর মুখে শোভা পায় ভদ্র-মার্জিত ভাষা, যিনি মর্যাদা, জ্ঞান এবং আত্মসম্মানের সাক্ষাৎ প্রতিবিম্ব । সুষমা স্বরাজ এমন একজন মহিলা যাঁর কপালের টিপটিরও নিজস্ব গরিমা ছিল । যাঁর সিঁদুর ছিল তাঁর হৃদয়ের অফুরান ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ । আর যাঁর শাড়ি ছিল প্রতিটি ভারতীয় মহিলার আত্মসম্মানের অনন্য প্রতীক। সুষমা স্বরাজ ছিলেন এমন একজন নেত্রী যিনি সব ধরনের ভাষাতেই ছিলেন স্বচ্ছন্দ, বিশেষ করে তাঁর হিন্দি এবং ইংরেজি ছিল নির্ভুল, নিখুঁত। বিষয় রাজনৈতিক হোক বা অরাজনৈতিক, দু’ক্ষেত্রেই তাঁর জ্ঞান ছিল অপরিসীম। এমনকী, এমনিতে মৃদু ও মিষ্টভাষী হলেও পরিস্থিতির প্রয়োজনে কঠোর হতেও দেরি করতেন না এক মুহূর্ত। বক্তা হিসাবে সুষমা স্বরাজ ছিলেন অসাধারণ আর সাংসদ হিসাবে অতুলনীয়। বিদেশমন্ত্রী হিসাবে তিনিই ভারতকে আন্তর্জাতিক মানচিত্রে প্রাপ্য স্বীকৃতি অর্জনের রাস্তা দেখিয়েছিলেন। সর্বোপরি তিনি ছিলেন একজন কিংবদন্তি রাজনীতিক । ২০১৯ সালের ৭ অগাস্ট তিনি প্রয়াত হন । এবছর তাঁকে মরণোত্তর পদ্মবিভূষণ সম্মানে ভূষিত করা হয় ।
যদি কেউ মনে করেন, সুষমা স্বরাজকে নিয়ে বই লিখবেন, তাহলে তাতে অসংখ্য পৃষ্ঠা থাকলেও লেখা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। নরেন্দ্র মোদি সরকারের ক্যাবিনেটে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ সোশাল মিডিয়ায় তাঁর সক্রিয় উপস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে শুধুমাত্র প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরেই পৌঁছাতে সক্ষম হননি, বরং তাঁর রাজনীতিজ্ঞান, তাঁর দূরদর্শিতা, তাঁর দায়িত্ব পালন এবং স্বপ্ন পূরণের প্রতিশ্রুতিরক্ষা—সব কিছুই আমাদের সকলের কাছে খুব স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। কারণ আজও তাঁর টুইটার হ্যান্ডলে এই পিন্ড টুইটটি জ্বলজ্বল করছে যে, ‘‘যদি মঙ্গল গ্রহেও কেউ আটকে পড়েন, ভারতীয় দূতাবাস আপনাকে সাহায্য করবে।” আর আমরা সকলেই জানি, তাঁর শেষ টুইটটি পড়ে গোটা দেশের চোখ ভিজে গেছিল। কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের পর প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে টুইটটি করেছিলেন তিনি ।
দেশে জরুরি অবস্থা চলাকালীন আইনের পড়ুয়া সুষমা ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন । পরে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। নানা ভাষায় কথা বলতে প্রশিক্ষিত । সুষমা যখনই কিছু বলতেন, তা সে সংস্কৃতেই হোক বা হিন্দি বা ইংরেজি বা উর্দু বা পাঞ্জাবি— এমনকী হরিয়ানভি ভাষাতেও কথা বললে সুষমা শ্রোতাকে নিজের শব্দ চয়ন এবং কণ্ঠের জাদু দিয়ে মুগ্ধ করতেন। এই অননুকরণীয় বাগ্মিতার জন্যই সর্বকালের সেরা বাগ্মীদের তালিকায় প্রয়াত অটলবিহারী বাজপেয়ি, লালকৃষ্ণ আদবানি, প্রয়াত প্রমোদ মহাজনদের সঙ্গেই আলাদা করে নিজের স্থান করে নিয়েছেন সুষমা। আর বাগ্মিতার প্রসঙ্গ উঠলে কে-ই বা ভুলতে পারে ১৩ দিনের অটলবিহারী বাজপেয়ি সরকারের পতনের পর লোকসভায় সুষমা স্বরাজের দেওয়া সেই স্মরণীয় বক্তৃতার কথা ! সংসদ হোক বা মিছিল, জনসভা হোক বা কোনও আনুষ্ঠানিক জমায়েত, তাঁর বাগ্মিতার সম্মোহনে সকলেই বাঁধা পড়তেন। এমনকী আন্তর্জাতিক মঞ্চেও তাঁর অভিজ্ঞ এবং জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দেশবাসীকে গর্বে ভরিয়ে তুলত।
সুষমা স্বরাজকে প্রায়ই ভারতীয় রাজনীতির একজন স্বচ্ছতার প্রতীকরূপে ধরে নেওয়া হয়েছে। এহেন সুষমা কিন্তু কখনওই, কোনও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, ভয় পেয়ে, পিছিয়ে আসতেন না। আর সম্ভবত এই কারণেই যখন দলের মনে হয়েছিল, দেশের রাজধানী পরিচালনা করার দায়িত্ব কোনও বরিষ্ঠ, অভিজ্ঞ এবং দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন রাজনীতিকের হাতে তুলে দেওয়া দরকার, এই টিম প্লেয়ার ভয়ে পিছিয়ে যাননি এবং দিল্লির প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করতে এক ফোঁটাও ইতঃস্তত বোধ করেননি।
এই সদাহাস্যময়ী ব্যক্তিত্বের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য এটাই ছিল যে বিরোধী শিবিরের সকলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো ছিল । একমাত্র ব্যতিক্রম সোনিয়া গান্ধি । কোনও অজানা কারণে কখনও সোনিয়া গান্ধির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠেনি সুষমার। ২০০৪ সালে যখন ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স (UPA) ক্ষমতায় আসে তখন প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে সোনিয়া গান্ধি বসতে পারেননি তাঁর দৃঢ় বিরোধিতার কারণেই। ঘটনায় সকলেই অবাক হয়েছিল যখন কারণ দেখিয়ে সুষমা বলেছিলেন, “আমি যদি সংসদে গিয়ে বসি, তাহলে আমাকে সোনিয়া গান্ধিকে সম্বোধন করতে হবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হিসাবে । যা আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়। ভারতীয় হিসাবে যে গর্ব আমার রয়েছে, তা আমায় এটা করতে অনুমতি দেয় না । আর আমি এটা করে জাতীয় লজ্জা বয়ে আনতে পারব না।” তিনি আরও বলেছিলেন, সোনিয়া গান্ধি দেশের প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি শোকে মাথার চুল কেটে ন্যাড়া হবেন। আর শুধু তা-ই নয়। সুষমা বলেছিলেন, সোনিয়া প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি মাটিতে শোবেন এবং শুকনো বাদাম খেয়ে জীবনধারণ করবেন। প্রসঙ্গত, ১৯৯৯ সালে বল্লারি কেন্দ্রে সোনিয়া গান্ধির সঙ্গে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সুষমা । সোনিয়ার কাছে ৫৬,০০০ ভোটে হেরে যান তিনি। ঘটনাচক্রে, সেই সময় বল্লারির মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ নিবিড় করতে মাত্র এক মাসের মধ্যেই কন্নড় ভাষাও শিখেছিলেন সুষমা ।
সুষমা স্বরাজের ব্যক্তিগত জীবন
১৯৫২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আম্বালা ক্যান্টনমেন্টে জন্ম সুষমার। তাঁর বাবা হরদেব শর্মা ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের একজন বরিষ্ঠ এবং প্রভাবশালী সদস্য। সুষমার বাবা-মা, জন্মসূত্রে দু’জনেই পাকিস্তানের লাহোরের ধরমপুরার বাসিন্দা। ১৯৭৫ সালের ১৩ জুলাই স্বরাজ কৌশলের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। ১৯৭৫ সালে দেশে জরুরি অবস্থার সময়ই দু’জনে কাছাকাছি আসেন। তাঁদের এক মেয়ে, নাম বাঁশুরি।
সুষমা স্বরাজের রাজনৈতিক জীবন
সত্তরের দশকে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (ABVP)–যোগ দেন সুষমা। ধীরে ধীরে হলেও ক্রমশ দলের ভিতরে তাঁর গুরুত্ব বাড়তে থাকে। ১৯৭৭ সালে হরিয়ানায় তাঁকে দেবী লালের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন জনতা পার্টি সরকারে একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর পদ দেওয়া হয়। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৫ বছর। সেই সময় বিধানসভায় তিনিই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। এর পর তিনি শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। হরিয়ানায় জনতা পার্টির রাজ্য প্রধান পদের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে ন্যস্ত করা হয় মাত্র ২৭ বছর বয়সেই। সুষমা স্বরাজ চার বছর জনতা পার্টির জাতীয় কার্যনির্বাহী কর্তৃপক্ষের অংশ ছিলেন। চার বছর ধরে তিনি হরিয়ানায় জনতা পার্টির প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে তিনি ভারতীয় জনতা পার্টির জাতীয় সচিবও হয়েছিলেন।
১৯৯০ সালে তিনি কাউন্সিল অফ স্টেটসের (রাজ্যসভা) সদস্য হিসাবে মনোনীত হন। ১৯৯৬ সালে একাদশ লোকসভায় দ্বিতীয় দফার জন্য সদস্য হন তিনি। তাছাড়াও মাত্র ১৩ দিন মেয়াদের অটলবিহারী বাজপেয়ি সরকারের ক্যাবিনেটে সুষমা ছিলেন তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী। ১৯৯৮ সালে দ্বাদশ লোকসভার সদস্য হিসাবে তৃতীয় বারের জন্য নির্বাচিত হন তিনি। তারপর ১৯৯৮ সালের ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত দিল্লির প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর হওয়ার সম্মান সুষমা অর্জন করেন, দিল্লির হাউজ় খাস কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হওয়ার পর। পরে যে পদ তাঁকে ছাড়তে হয়েছিল রাজ্যসভায় নিজের সদস্যপদ ধরে রাখার জন্য।