পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / bharat

নতুন বৈষম্যের জন্ম দিয়েছে কোরোনা ! - কোরোনা

সংস্থান যত বেশি ব্যয় হবে, তত উন্নয়ন হবে – এই মিথ্যা প্রতিশ্রুতি উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করেছে। তারা বিশ্বজুড়ে বৈষম্যের গতিকে ত্বরান্বিত করেছে । লিখছেন ইন্দিরা গোপাল

corona-fuels-new-ineqalities
corona-fuels-new-ineqalities

By

Published : Dec 30, 2020, 1:52 PM IST

গরিবের অসহনীয় জীবন

“মনে রেখো, আমরাই 99 জন, একমাত্র তুমি অন্যদিকে আছো।” 2011 সালে, আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের ভরকেন্দ্র নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটে পতাকা হাতে এই স্লোগানই তুলেছিল মানুষ। 9 বছর আগে নিউইয়র্কে, আর্থিক বৈষম্য ও বঞ্চনার প্রতিবাদে ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল করো’ নামে যে অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল, তা একমাসের মধ্যেই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়া এই প্রতিবাদ, বিশেষ করে উত্তর অ্যামেরিকা ও ইউরোপে আরও 750টি বিক্ষোভের সূচনা করে। বিশ্বের ধনীতম এক শতাংশ মানুষের সম্পদ বাড়তে থাকার যে বিতর্ক, তা কোভিডকালে আরেকটা মোড় নেয়। কয়েকমাস আগেই যখন ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড (আইএমএফ) হুঁশিয়ারি দিয়ে বলে, বিশ্বের অগ্রগতি ভাইরাসের ধাক্কায় দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তখন কোভিডের জেরে অন্তত দশ কোটি মানুষ ভয়াবহ দারিদ্রের মধ্যে পড়েছেন। এখানে উল্লেখ্য যে কোভিড মহামারির সময় যেখানে বিশ্বের ধনীতম প্রথম দশজনের সম্পদের পরিমাণ 30 ট্রিলিয়ন ডলার বেড়েছে, সেখানে দিনে 2 ডলারেরও কম আয় করা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে আরও দশ কোটি।

বঞ্চনার পরীক্ষা-নিরীক্ষা

সংস্থান যত বেশি ব্যয় হবে, তত উন্নয়ন হবে – এই মিথ্যা প্রতিশ্রুতি উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করেছে। তারা বিশ্বজুড়ে বৈষম্যের গতিকে ত্বরান্বিত করেছে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের সর্বশেষ রিপোর্ট বলছে, কোভিডের জেরে কাজ হারিয়ে দারিদ্রের অতলে ডুবে যাওয়া মানুষের সংখ্যা গ্রামের তুলনায় শহরাঞ্চলে বেশি। কোভিড সেই সব লাখ লাখ মানুষের জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, যাঁরা বস্তিতে থাকেন এবং ছোটোখাটো শ্রমিক হিসেবে বা শিল্পক্ষেত্রে কাজ করেন। আফ্রিকা ও এশিয়ার বেশ কিছু দেশে করা বিশ্ব ব্যাঙ্কের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, শহরের মানুষই দারিদ্রের কবলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কোভিড দক্ষিণ এশিয়ায় অন্তত সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষকে দারিদ্রের দিকে ঠেলে দিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর তালিকার একেবারে নিচের দিকে থাকা 47টি দেশের আর্থিক অবস্থা সবথেকে খারাপ। বিশ্ববাণিজ্য ভেঙে পড়েছে, পর্যটন থমকে গিয়েছে এবং লকডাউনের জেরে কর্মসংস্থানের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। গরিব দেশগুলোর বাণিজ্য ঘাটতি গত বছরের 9.1 হাজার কোটি ডলারের ঘাটতিকেও ছাপিয়ে যাবে বলে করা হচ্ছে। কোরোনার সঙ্গে লড়তে না পেরে 110টিরও বেশি দেশ আইএমএফের কাছে মানবিক ও আর্থিক সহায়তা চেয়েছে। বড় দেশগুলো ঘোষণা করেছে যে তারা চলতি বছরের শেষ পর্যন্ত গরিব দেশগুলোর ঋণ পরিশোধ স্থগিত রাখবে। এর ফলে ওইসব দেশগুলোকে এবছর 73 মিলিয়ন ডলার শোধ করার বোঝা হালকা হয়েছে । কিন্তু সবথেকে বড় প্রশ্ন হল, কী করে তারা এই বোঝা বইবে, যেটা সামনের বছরই দ্বিগুণ হয়ে যাবে? কোরোনা নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকসিনের জন্য অন্তহীন অপেক্ষা করে চলেছে গরিব দেশগুলো। ধনী দেশগুলো, যেখানে বিশ্বের জনসংখ্যার মাত্র 14 শতাংশ মানুষ থাকে, এরমধ্যেই সমস্ত ভ্যাকসিনের 53 শতাংশ কিনে নেওয়ার তোড়জোড় করে ফেলেছে। তারা সামনের বছর শেষের মধ্যে তাদের জনগণকে ভ্যাকসিনের তিনটি ডোজ় দিতে তৈরি। শীর্ষে রয়েছে কানাডা, যারা প্রয়োজনে প্রত্যেককে পাঁচবার করে ভ্যাকসিন দিতে পারে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে, বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ আরও একবছর ভ্যাকসিন পাবে না।

নতুন মডেলের প্রয়োজনীয়তা

কিছু লোক সম্পদ উপভোগ করছে, এবং বেশিরভাগ মানুষ দারিদ্রের সঙ্গে যুঝছেন – এই ছবি শুধু তৃতীয় বিশ্বেই সীমাবদ্ধ নেই। এটা ধনী দেশগুলোতেও আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে অর্গানাইজ়েশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)-এর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতে আর্থিক বৈষম্য যতটা বেড়েছে, সেটা গত 50 বছরে দেখা যায়নি। এর থেকেই বোঝা যায় কোরোনা বিশ্বজুড়ে কতটা গভীর প্রভাব ফেলেছে। লাখ লাখ লোক গভীর দারিদ্রের মধ্যে ডুবে যাবে, যদি তাঁদের হাসপাতালের বিপুল চোকাতে হয়, কিংবা এক বছরও ফসল নষ্ট হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে গরিব সম্প্রদায়ের মানুষের, সচ্ছল পরিবারের তুলনায় গড়ে 15 বছর আগে মৃত্যু হয়। বড় দেশগুলোর এবং বহুজাতিক সংস্থাগুলোর নীতির ফলে গরিব দেশগুলোর সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে যে পরিবর্তন আসছে, তা নিয়ে বহু আলোচনা হচ্ছে। যেটা প্রয়োজন, সেটা হল ইচ্ছাশক্তি এবং যথাযথ পরিকল্পনা রূপায়ণে একাগ্রতা। কোরোনা পরিস্থিতির মধ্যে আমরা আবার আমাদের বর্তমান মডেলগুলোকে বদল করার এবং পরিবেশবান্ধব পথে অর্থনীতিকে চালিত করার সুযোগ পেয়েছি। আমরা যদি এই সংকটকে সুযোগে রূপান্তরিত করতে পারি, তাহলে নিশ্চিতভাবেই বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থার পথে সেটা হবে প্রথম ধাপ।

ABOUT THE AUTHOR

...view details