জন্মের সময় থেকে স্বাবলম্বী হওয়া পর্যন্ত, ছোটোদের অনেক যত্নের দরকার । বিশেষ করে এই বছরে, যখন বিশ্ব কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত, তখন ছোটোদের মারাত্মক ভাইরাসের কবল থেকে দূরে রাখতে অতিরিক্ত সতর্ক হওয়ার জন্য বাবা-মাদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে । এই ভাইরাস আরও অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে, যেমন শুধুমাত্র অনলাইন ক্লাস করেই গোটা শিক্ষাবর্ষ শেষ করা । এটা শিশু, শিক্ষক এবং বাবা-মা, সবার কাছেই চ্যালেঞ্জিং। শিশুরা গ্যাজেটের পিছনে বেশি সময় দিয়েছে, যার জেরে তাদের মানসিক ও মনস্তাত্বিক অবস্থায় গুরুতর প্রভাব পড়েছে । এই বছর কোরোনা ভাইরাসের পাশাপাশি, শিশুদের স্বাস্থ্য নিয়ে কিছু বিষয়ের দিকে চোখ রাখা যাক, যা বছরভর বারবার আলোচনায় উঠে এসেছে।
কোভিড-১৯
যখন এই রোগ সম্পর্কে আমরা কম জানতাম, তখন শিশুরা বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছিল । কিন্তু আস্তে আস্তে যখন আমরা এই নতুন ভাইরাস সম্পর্কে আরও জানলাম, তখন বুঝতে পারলাম যে বড়দের তুলনায় ছোটোদের ওপর এই ভাইরাসের প্রভাব কম পড়ে । আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে অনেক কম উপসর্গ দেখা গেছে, যা অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা কমিয়েছে।
কিন্তু অসুখের পাশাপাশি কোভিড-১৯ কচিকাঁচাদের মানসিক স্বাস্থ্যে খারাপ প্রভাব ফেলেছে। এর জেরে ছোটোরা ঘরেই আটকে পড়েছে। স্কুল বন্ধ হয়ে যায়, বাইরে বেরোনোর উপরও নিষেধাজ্ঞা এসে পড়ে। এর জেরে তাদের মধ্যে একঘেয়েমি, দুশ্চিন্তা, খিটখিটে ভাব, অবসাদ ও আলস্য চেপে বসে। তারা নিজেদের বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্নবোধ করতে থাকে। তাদের মানসিক অবস্থার উপর এসব কিছুরই বিরূপ প্রভাব পড়ে।
স্থূলতা
বাচ্চাদের স্বাস্থ্য নিয়ে আরেকটি যে সমস্যা সামনে এসেছে, তা হল ওবেসিটি বা স্থূলত্ব । লকডাউনে ঘরবন্দি থেকে স্ক্রিনটাইম বেড়ে গেছে, পাশাপাশি চলেছে বেলাগাম খাওয়াদাওয়া । নির্দিষ্ট রুটিন, শরীরচর্চার অভাব এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের জেরে ওজন বেড়েছে । বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে , শিশুদের ওবেসিটি থেরে ক্লান্তি, ঘুম না আসা, টেনশন বেড়ে যাওয়া এবং কিছু ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট পর্যন্ত হতে পারে । যদি সমস্যা বাড়তে থাকে, সেখান থেকে ডায়াবিটিস, হৃদরোগ, হাইপারটেনশন, ঘুম না আসার মতো গুরুতর অসুখ দেখা দিতে পারে । তাই কোরোনাভাইরাসের ভয়ের পাশাপাশি, শিশুদের ওবেসিটি বাবা-মাকে বেশি আতঙ্কিত করছে ।
সদ্যোজাতদের স্বাস্থ্য
সদ্যোজাতদের ক্ষেত্রে অনেকগুলি চ্যালেঞ্জ সামনে থাকে, কারণ অনেক কারণেই তাদের বৃদ্ধি ও শরীরের বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে। এবছর আমরা আলোচনায় তুলে এনেছি, যে কীভাবে সামান্য কিছু পদক্ষেপে শিশু সুস্থ থাকতে পারে । একবার ফিরে দেখে নেওয়া যাক:
-ম্যাসাজ:
শিশুর অভয়াঙ্গ বা ম্যাসাজ স্নানের আগে প্রতিদিন করা উচিত, যাতে ক্লান্তি দূর হয়, রক্ত সঞ্চালন আরও ভালো হয় এবং হজমশক্তি বাড়ে। এর ফলে শিশুর ত্বক ও চুলও ভাল হয় । শিশুকে মালিশ করলে তার হাড়, অস্থিসন্ধি ও পেশী মজবুত হয়। আপনি জন্মের এক সপ্তাহ পরে হালকা ম্যাসাজ দিয়ে শুরু করতে পারেন । কিন্তু শিশু এইসময় খুবই স্পর্শকাতর হয়, ফলে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত । এছাড়াও, যদি এই মালিশ যদি বেলা 10টা থেকে 12টার মধ্যে রোদ্দুরে করা হয়, বা ম্যাসাজের পর শিশুকে রোদে কিছুক্ষণ রাখা হয়, তাহলে সে প্রয়োজনীয় ভিটামিন-ডি পেতে পারে ।
-পুষ্টি:
সঠিক পুষ্টি শিশুর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় । প্রথম ছয় মাস তাদের শুধুই স্তন্যপান করানো উচিত । প্রথম স্তনদুগ্ধকে কলোস্ট্রাম বলে এবং শিশুর জন্মের পরই তা খাওয়ানো উচিত । বলা হয় যে এই কলোস্ট্রাম শিশুকে বহু অসুখ থেকে ভ্যাকসিনের মতো রক্ষা করে । ছয় মাস পর থেকে অন্যান্য তরল ও অর্ধতরল খাবার, যেমন ডালের জল, ফ্যান দেওয়া যেতে পারে । ফল ও সবজির রসও তাদের খাদ্যতালিকায় রাখা যেতে পারে । সাত মাসের পর শিশুকে হালকা শক্ত খাবার, যেমন সুপ, এবং গুঁড়ো করা খাবার, যেমন ভেজিটেবল ব্রেড, ডাল, ভাত, মুসুর ডাল ও চিজ় দেওয়া যেতে পারে । বিশেষজ্ঞরা বলেন, মধু, ডিম, মাছ, মাংস, শুকনো ফল, অতিরিক্ত নুন বা চিনি একদম ছোটোদের না খাওয়ানোই ভালো । দুধের বদলে শক্ত খাবার, বা উলটোটা করবেন না । দুধ ছাড়াও পনির, দই, ঘি, মাখনের মতো দুগ্ধজাত খাবারও তাদের খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ।
ছয় থেকে 18 মাসের মধ্যে বাচ্চাদের দাঁত গজাতে শুরু করে। এই সময়টা তাদের কাছে একটু সমস্যার হতে পারে। তাই ৬ মাস হলেই বিশেষজ্ঞরা ডেন্টিস্টের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন। অন্তত চার বছর শিশুকে অতিরিক্ত চিনি বা চকলেট দেবেন না, এবং নিশ্চিত করুন যাতে দাঁত সঠিকভাবে ব্রাশ করা এবং পরিষ্কার রাখা হয় ।
কৃমির সংক্রমণ
1 থেকে 14 বছরের শিশুদের কৃমির সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে । এধরনের একটি সমস্যা হল মাটি থেকে আসা হেলমিন্থ (এসটিএইচ) বা অন্ত্রের কৃমি । আমাদের দেহে প্রবেশ করলেই এই কৃমিরা ক্ষুদ্রান্তে পৌঁছে যায় এবং পুষ্টি শোষণ করতে থাকে । সঠিক সময়ে ব্যবস্থা না নিলে, এর থেকে অ্যানিমিয়া, অভ্যন্তরীণ রক্তপাত ও অপুষ্টি তৈরি হতে পারে । তাই বিশেষজ্ঞরা বছরে একবার করে শিশুদের ডিওয়ার্মিংয়ের পরামর্শ দেন ।
চোখের সমস্যা
বাইরে যাতায়াত সীমাবদ্ধ হয়ে পড়া এবং মহামারীর সময় অনলাইনে ক্লাসের জন্য, ছোটোদের স্ক্রিনটাইম বেড়ে গেছে, যার জন্য চোখের নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে । শিশু চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্ধিত স্ক্রিনটাইম ছোটোদের মধ্যে দূরের জিনিস দেখার ক্ষেত্রে সমস্যা বা মায়োপিয়া, মায়োপিয়া থাকলে তা বেড়ে যাওয়া, স্ট্রেস, আচরণঘটিত সমস্যা, সামাজিকতার অভাব ও ঘুমের ব্যাঘাতের মতো সমস্যা তৈরি করতে পারে । তাই পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে যে:
- বাচ্চাদের চশমা পরতে বলা হয়, তারা যেন নিয়মিত তা পরে ।
- 20-20-20 নিয়ম মেনে চলতে হবে, অর্থাৎ 20 মিনিটের পর 20 সেকেন্ডের ব্রেক । সেসময় 20 ফুট দূরের কোনও জিনিসের দিকে তাকাতে হবে ।
- বিভিন্ন বোর্ড গেম বা কাজকর্মের মধ্যে ছোটোদের ব্যস্ত রাখুন ।
- স্ক্রিনের উজ্জ্বলতা কমাতে স্ক্রিন প্রোটেক্টর ব্যবহার করা যেতে পারে ।
- নিশ্চিত করুন যাতে বাচ্চা প্রতিদিন স্বাস্থ্যকর ও সুষম খাবার খায়।
সুতরাং, আপনার সন্তানকে সুস্থ ও ফিট রাখতে তাদের ভালো খাওয়াদাওয়া ও নিয়মিত শরীরচর্চায় উৎসাহিত করতে হবে । তাদের রুটিনে ব্যায়াম বা ওয়ার্কআউট অন্তর্ভুক্ত করতে হবে । যেহেতু ছোটোরা বড়দেরই অনুসরণ করে, তাই আপনার সন্তানের কাছে আপনিই রোল মডেল হয়ে উঠুন ।