অ্যামেরিকার থেকে ভীত হয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ভারতকে সরিয়ে দেওয়া এবং চাবাহার বন্দর থেকে জাহেদান পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ নির্মাণ একাই করার সিদ্ধান্ত ইরান রাতারাতি নেয়নি ৷ এটা ধীরে ধীরে নেওয়া হয়েছে ৷
এই রেলপথের ভবিষ্যৎ নিয়ে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য ভারতীয় রেলের অধীনে থাকা IRCON নামে একটি সংস্থা MoU সাক্ষর করেছিল ৷ এই রেলপথ ভারত, ইরান ও আফগানিস্তানের মধ্যে একটি ত্রিপাক্ষিক যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করতে সাহায্য করছিল ৷ ২০১৬ সালে যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তেহরানে গিয়েছিলেন, তখন এই নিয়ে চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছিল ৷ চাবাহার বন্দর ইরানের দক্ষিণ পূর্ব অংশে ওমান সাগরের উপর অবস্থিত ৷ যার এই যোগাযোগে মূল ভূমিকা পালন করার কথা ছিল ৷
সুতরাং, যখন তেহরান বলছে যে ইরান এই রেলপথ তৈরির জন্য ভারতের সঙ্গে কোনও চুক্তি করেনি, তারা কিন্তু ভুল নয় ৷ ভারত এই বিষয়ে তাদের আগ্রহের কারণ জানিয়েছিল ৷ কিন্তু রেলপথ নির্মাণ ইত্যাদির মতো কোনও কিছু তৈরি করতে বাস্তবে উদ্যোগী হয়নি ৷ ভারতীয় রেলের অধীনে থাকা নির্মাণ সংস্থা IRCON শুধুমাত্র সম্ভাব্যতার রিপোর্ট তৈরি করেছিল ৷ বাকি কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল ১৫০ মিলিয়নের মতো টাকা ৷ চাবাহার বন্দরের সঙ্গে সফল ভাবে যোগাযোগ স্থাপনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ নির্মাণের জন্য ভারত কেন প্রয়োজনীয় অর্থের ব্যবস্থা করল না ৷ এখানে একাধিক তত্ত্ব ও কারণ উঠে আসছে ৷ এর মধ্যে ইরান ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে যে মহান দেশ হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনকে ব্যবহার করেনি এবং দেশের প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবে কাজ করেনি ৷ এর বদলে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে মাথা নত করার জন্য নিজেদের অনুমতি দিয়েছে ৷ এই প্রকল্পে টাকা দিতে দেরি করার জন্য ভারতের তরফে কারণ ছিল যে এর জন্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হতে পারে ৷ যদিও ওয়াশিংটন চাইছিল যে চাবাহারের এই প্রকল্প তৈরি হোক ৷ কারণ, এতে আফগানিস্তানের বাণিজ্যে সুবিধা হবে ৷ পাকিস্তানের করাচি বিমানবন্দরের উপর তাদের নির্ভরতা কমবে ৷ কারণ, এটা জটিল ও অনেক দূরে অবস্থিত ৷ তবে সম্প্রতি পাকিস্তান কাবুলের সরকারকে তাঁদের সামগ্রী ওয়াঘা সীমান্ত দিয়েই নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে ৷ এই দৃষ্টিকোণ থেকেই ভারতের ভয় অতিরঞ্জিত ।
আসল কারণ রয়েছে অন্য জায়গায় ৷ তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও অনুচ্ছেদ ৩৭০ এর অবলুপ্তি ঘটানো এবং যে পদ্ধতিতে ভারত সরকার কাশ্মীরের অবস্থা বদল করে দিয়েছে, তা নিয়েই ইরানের সঙ্গে ভারতের দূরত্ব তৈরি হয়েছে ৷ ভারত সরকারের বিরুদ্ধে নাগরিকের অধিকার দমন করার অভিযোগ তুলে সমালোচনা করেছে ইরানের সরকার ৷ ভারতের এই পদক্ষেপ ইসলামিক বিশ্বেও যথেষ্ট ক্ষোভ তৈরি করেছে ৷ পরে ইরানের সুপ্রিম লিডার আয়তোল্লা খাইমেনি ভারতের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (CAA)-এর সমালোচনা করেন ৷ কেন এই মুসলিম বিরোধী পদক্ষেপ, সেই প্রশ্ন তোলেন ৷ দিল্লি হিংসা, যে ঘটনাকে অনেকেই সাম্প্রদায়িক হিংসা বলে বর্ণনা করেছেন, তা নিয়েও ইরানিরা সমালোচনা করেছে ৷
কাশ্মীর ইরানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ৷ কারণ, এই জায়গাকে তারা ‘‘সাঘির-ই-ইরান’’ বা মিনি ইরান বলে থাকে ৷ তারা মনে করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে লড়াইয়ের জন্যই কাশ্মীরের অবস্থা স্থিতিশীল নয় ৷ তারা কূটনৈতিক মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছিল ৷ আর চাবাহার, যা সিস্টান বালুচিস্তান প্রভিন্সে অবস্থিত, সেখানে ভারতকে কৌশলগত জায়গা করে দিয়েছিল ৷ যাতে পাকিস্তানের উচ্চাভিলাষের বিরুদ্ধে কাজ করা যায় ৷
কাশ্মীরে পাকিস্তানকে ছাড়া এবং ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করার বিষয়টি শুরু হয়েছিল ইরানি জেনারেল কোয়াসিম সুলেমানির সময় থেকে ৷ চাবাহারের কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি কোয়াড ফোর্সের এই প্রধান চাইতেন যে ভারত এই বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ করুক ৷ দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই কারণেই তাঁকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা হত্যা করা হয় ৷ ইরান, তাদের নিজেদের কৃতিত্বে চাবাহারকে চিনের দিকে ঠেলে দেয়নি ৷ বরং এটা অনেক সহজ কাজ ছিল ৷ কারণ, মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরে পাকিস্তানের বন্দর গদর অবস্থিত ৷ যা গড়ে তোলার কাজ করছে চিন ৷ চিন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের (CPEC) জন্যই এটা গড়ে তোলা হচ্ছে ৷ চাবাহারের নিয়ন্ত্রণ নিজেদর হাতে নিতে পারলে চিন খুবই আনন্দিত হত ৷ কিন্তু ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং ভারতের জন্য পাকিস্তানকে কোণঠাসা করতে ও মধ্য এশিয়ায় পৌঁছতে এর কৌশলগত অবস্থান সম্পর্কে ইরান অবগত ৷ ইরান নিজেদের সভ্যতা এবং স্বাধীন বৈদেশিক নীতি নিয়ে খুবই গর্বিত ৷ এর ফলে তাদের স্বাধীনতা যাতে কখনও খর্ব না হয়, তার জন্যও তারা সর্বদা সচেতন থাকে ৷ এমনকী তারা যখন মার্কিন নিষেধাজ্ঞার অধীনে ছিল, তখনও এই বিষয়টিতে সচেতন ছিল ৷ তারা আশা করেছিল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা ওই বন্দরে ব্যবসার কাজে সাহায্য করবে ৷ যেখানে হরমুজ প্রণালির বন্দর আব্বাস তেল রপ্তানি ইত্যাদি কারণে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে ৷ আফিগানিস্তান নিয়ে সন্দেহ না কাটায় ভারত এই বন্দরের পূর্ণ ক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পরও পুরোপুরি উদ্যোগী হয়নি ৷ আফগানিস্তানে যে বিনিয়োগ করা হয়েছে, তালিবানরা ক্ষমতায় এলে তার কী হবে, এই প্রশ্নের উত্তর তারা খুঁজছে ৷ মার্কিন মধ্যস্থতাকারী জালময় খালিজাদ যে নতুন চুক্তি করেছেন, তাতে কি ভারতের বিনিয়োগ সুরক্ষিত হচ্ছে ৷ যদিও তালিবান বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করছে ৷ তা সত্ত্বেও তারা কাবুলের দখল নেওয়ার পর ঠিক কী হবে, তা নিয়ে অনেকেই চিন্তিত ৷ অতীতে তারা নিজেদের আইনশৃঙ্খলাহীন বাহিনী হিসেবে পরিচিত করে তুলেছে ৷ আর এটাই ভারতের অনীহার অন্যতম কারণ ৷
উত্তর লাদাখে ভারত ও চিনের মধ্যে যে মুখোমুখি লড়াইয়ের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, সেটাই ইরান খুব ভালো ভাবে নজর করছিল ৷ চিন যেভাবে ভারতের অংশ দখল করেছিল, তাতে একটা ছবি তৈরি হয় যে তারা নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না ৷ চিন দক্ষিণে নিজেদের শক্তির ভারসাম্যের পুনর্বিন্যাস করার চেষ্টা করছিল এবং এই কারণেই বেজিংয়ের প্রতি ইরানের মনোভাবে বদল ঘটেছে ৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার জন্য ইরানকে যে সমস্যার মধ্যে পড়তে হয় এবং অর্থের অভাবে ভুগতে হয়, সেই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তারা ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তির সুযোগ গ্রহণ করেছে ৷ যে চুক্তি তারা ২০১৬ সাল থেকে স্থগিত করে রেখে দিয়েছিল ৷ ইরান এটা বোঝানোর চেষ্টা করছে যে তারা তাদের জমি চিনকে দেয়নি ৷ তবে তারা এটাও স্পষ্ট করেছে যে প্রয়োজনে তারা তাদের বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন আনতে পারে ৷ যাতে এশিয়ার দুইটি শক্তিধর দেশের লড়াইয়ের মাঝে তারা পড়ে না যায় ৷
বাস্তবে চাবাহার রেল প্রকল্প যেমনটা ভারত চেয়েছিল, সেই ভাবে তৈরি হয়নি ৷ তার মানে হল চিন প্রবেশ করার পর এবং অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে ভারতের ক্ষতি এবং প্যানডেমিক পরবর্তী বিশ্বে বিভিন্ন দেশের নিজেদের পরিবর্তিত করার জন্য ওই অঞ্চলের বাস্তব পরিস্থিতিতে বদল ঘটেছে ৷