মানুষকে সত্যটা জানতে দাও, তাহলেই দেশ নিরাপদে থাকবে-বলেছিলেন অ্যামেরিকার 16তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন। এই কথাটা স্বচ্ছ্বতা এবং দায়বদ্ধতার দিকে ইঙ্গিত করে। আরও গুরুত্বপূর্ণ, এতে জনসাধারণের তথ্য জানার অধিকারের উপর জোর দেওয়া হয়েছে । যে কোনও জাতীয় সংকটের মোকাবিলা করতে, সরকারগুলিকে নির্ভরযোগ্য তথ্য নিয়ে তৈরি থাকতে হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, কেন্দ্রের কাছে এই প্যানডেমিক নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নেই, যা 53 লাখ মানুষকে সংক্রমিত করেছে এবং 90 হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে । যদিও সরকার আগেভাগে লকডাউন ঘোষণা করে 29 লাখ মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে, কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় যে সামনের সারির যোদ্ধারা মারা গেছেন, তাঁদের কোনও রেকর্ড নেই । যে পরিযায়ী শ্রমিকরা তাঁদের বাড়ি পৌঁছাতে কয়েকশো মাইল পথ হেঁটেছেন, তাঁদের নিয়েও কোনও তথ্য নেই সরকারের কাছে। এর উপরে, যে অসংখ্য ছোটো ও মাঝারি ক্ষেত্রের শ্রমিকরা তাড়াহুড়োর লকডাউনের জেরে কাজ হারিয়েছেন, তাঁদের ব্যাপারেও কিছুই জানে না কেন্দ্র । তাহলে লকডাউনের শুরু থেকে সরকারি ব্যবস্থা কী করছিল, যে তথ্য ও পরিসংখ্যানই মিলল না?
যখন কোরোনা প্যানডেমিক শুরু হয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশবাসীকে বললেন চিকিৎসক, প্যারামেডিকেল কর্মী, পুলিশ ও সাফাইকর্মীদের প্রতি সহমর্মী হতে । দেশ খুশি হয়েই তা মেনে নিল। এমনকী কোরোনা যোদ্ধাদের সম্মান জানাতে হাসপাতালগুলির উপর কেন্দ্রের পুষ্পবৃষ্টির সিদ্ধান্তকেও স্বাগত জানান নাগরিকরা। কোরোনা শহিদদের জন্য স্বাস্থ্যবিমারও প্রশংসা করেছি আমরা। রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে কয়েকশো ডাক্তার মারা গেছেন জানাটা আমাদের কাছে হৃদয়বিদারক । যখন এই কোরোনা শহিদদের সংখ্যা জানতে চাওয়া হয়, তখন কেন্দ্র বলে যে কেন্দ্রীয় স্তরে কোনও তথ্যই নেই। শুধুমাত্র গরিবকল্যাণ যোজনার মাধ্যমে যাঁরা সাহায্য চেয়েছেন, তাঁদেরই বিবরণ নথিবদ্ধ আছে।
অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (IMA) প্রধানমন্ত্রীকে একটি চিঠি দেয়, যাতে 196 চিকিৎসকের মৃত্যুর বিবরণ ছিল। PMO-র তরফে কোনও জবাব না আসার পর থেকে, এই মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে 392 হয়ে গেছে। IMA-র ডেটাবেস অনুযায়ী, কোরোনা আক্রান্ত চিকিৎসকদের মধ্যে সরকারি ক্ষেত্রের 8 শতাংশ এবং বেসরকারি ক্ষেত্রের 15 শতাংশ চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। কেন্দ্র যেখানে চিকিৎসকদের নিরাপত্তার জন্য শুধুমাত্র N-95 মাস্ক ও গ্লাভসের গাইডলাইন দিয়েছে, সেখানে IMA-র হিসেব অনুযায়ী, মৃত চিকিৎসকদের 40 শতাংশই কোরোনা রোগীদের চিকিৎসা করছিলেন। কোরোনা ভাইরাসে আক্রান্ত 2238 জন চিকিৎসেক মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন 382 জন। এই সংখ্যাটা (17.06 শতাংশ) মৃত্যুর জাতীয় গড়ের (1.7 শতাংশ) থেকে 10 গুণ বেশি। পরিসংখ্যান বলছে, মৃত চিকিৎসকের বেশিরভাগই অত্যন্ত অভিজ্ঞ জেনেরাল ফিজ়িশিয়ান ছিলেন। কয়েকটি ক্ষেত্রে 35 বছরের কম বয়সি চিকিৎসকরাও ভাইরাসের শিকার হয়েছেন। কর্নাটক, যারা চিকিৎসক সংকটে ভুগছে, তারা চূড়ান্ত বর্ষের মেডিকেল পড়ুয়াদেরও COVID ডিউটির জন্য তৈরি করছে । স্বাস্থ্যকর্মীদের আত্মত্যাগকে স্বীকৃতি ও সম্মান দেওয়ার বদলে সরকার তথ্য থেকে গা ঝেড়ে ফেলছে।
এই মাসের গোড়ার দিকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট বলছে যে বিশ্বজুড়ে 7000 স্বাস্থ্যকর্মী কোরোনায় মারা গেছেন। এর মধ্যে 573টি মৃত্যু শুধু ভারতেই । যেখানে বহু স্বাধীন সংস্থা যতটা সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করছে, সেখানে বিভিন্ন প্রকল্প রূপায়ণের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রকগুলি এতদিন কী করছিল? ভারত একমাত্র দেশ, যেখানে সম্পূর্ণ লকডাউন করা হয়েছে । বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্ট বলছে যে 24 মার্চ থেকে দেশজুড়ে শুরু হওয়া লকডাউন 4 কোটি পরিযায়ী শ্রমিকের জীবিকা ধ্বংস করেছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রক যথারীতি প্যানডেমিকে ক্ষতিগ্রস্ত অতিথি শ্রমিকদের সংখ্যা নিয়ে অবগত নয় । তথ্য নেই, তাই সহায়তাও নেই । কেন্দ্র দাবি করছে যে 63 লাখ শ্রমিককে 4611টি ট্রেনে বাড়ি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তাদের দুর্ভোগ ও মৃত্যুর দিকে নজরই দেওয়া হয়নি। লকডাউন দিনমজুরদের জীবনে যে বিপর্যয় নিয়ে আনল, সেদিকে দ্বিতীয়বার ফিরেও তাকায়নি কেন্দ্রীয় সরকার। মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, যা দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন, প্যানডেমিকের জেরে সম্পূর্ণ ধসে পড়েছে। লাখ লাখ কর্মী কাজ হারিয়েছেন। কেন্দ্র গর্বিতভাবে বলছে যে জীবিকা হারানো নিয়ে কোনও সমীক্ষা করাই হয়নি। এই শ্রমিকরা সম্মানের "আত্মনির্ভর ভারত অভিযান" থেকে কিছুই পায়নি। কোরোনার পর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে এই গা ছাড়া ভাব দূর করতে হবে। সামাজিক-অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের উৎস খুঁজে বার করতে এবং যথাযোগ্য সমাধান খুঁজে মৃতদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে কেন্দ্রের কাছে সঠিক তথ্য থাকতে হবে । সরকারকে কি তার দায়িত্বগুলি মনে করিয়ে দিতে হবে?