পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / bharat

নাগরিকত্ব আইন ইশুতে দ্বিধাবিভক্ত দেশ - নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন 2019

নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন 2019-র প্রতিবাদে দেশের নানা প্রান্তে চলছে বিক্ষোভ । একাধিক রাজ্যে বহুজনকে আটক করা হয়েছে । গাড়ি জ্বালানো থেকে স্টেশন ভাঙচুর । সরগরম উত্তর -পূর্বের রাজ্যগুলি সহ দিল্লি, কলকাতা, বিহার ও উত্তরপ্রদেশ। কী এই CAA । কোথায় সমস্যা ? একনজরে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন ।

caa
ছবি

By

Published : Dec 21, 2019, 3:32 PM IST

নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন পূর্ব ভারতকে নাড়িয়ে দিয়েছে । মূলত অসম, ত্রিপুরা এবং শিলংয়ে বিক্ষোভ দেখা গেছে । এই আইনে দু'ধরনের মতামত আছে । সমর্থকরা বলছেন, CAA হল অতীতের অন্যায় কাজের সংশোধন । অন্যদিকে, বিরোধীরা বলছেন এটা হল ধর্মের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে বিভাজনের একটা ঘৃণ্য চক্রান্ত ।1995 সালের নাগরিকত্ব আইন অনুসারে যাঁরা ভারতে বেআইনি পথে কোনওরকম নথি ছাড়া প্রবেশ করেছেন, তাঁদের নাগরিকত্ব বাতিলের কথা বলা হয়েছে।

যাই হোক, নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন সংখ্যালঘু উদবাস্তুদের ক্ষেত্রে বড় রকম ধাক্কা । অত্যাচারের ফলে পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান থেকে যে সব সংখ্যালঘুরা ভারতে প্রবেশ করেছিলেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এই আইন বড় ধাক্কা । তবে নয়া আইন চালু হলেও ওই সব মানুষগুলির কোনও চিন্তা নেই বলেই কেন্দ্রের তরফে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে । তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে । সংখ্যালঘুরা এসেছেন তিনটি ইসলামিক রাষ্ট্র থেকে । অন্যদিকে, হিন্দু, শিখ, জৈন, ক্রিশ্চান, বৌদ্ধ এবং পার্সিদের ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনও বাধা নেই । তবে আশ্চর্যের বিষয়, ওই তিন রাষ্ট্র থেকে যে সব মুসলিমরা ভারতে এসেছেন, তাঁদেরই বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁরা কোনও ধর্মীয় নিপীড়নের সম্মুখীন হননি এবং নিজেদের জীবন ভালো করার জন্যই অনুপ্রবেশ করেছিলেন। এটাই নতুন আইনের মূল কথা।

কয়েক শতকের সমস্যা

নিজেদের জীবন সুন্দর এবং স্বচ্ছন্দময় করার জন্য মানুষ অন্য দেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশ করেন এবং উদ্বাস্তু হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন । 1947 সালে দেশ ভাগের পর 1.5 কোটি মানুষ দুই দেশের সীমান্ত টপকে ছিলেন। ভারত-পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তে 1.2 কোটি মানুষ এবং পূর্ব সীমান্তে 42 লাখ মানুষ সীমান্ত পারাপার করেছিলেন । দেখা গেছে, 1959 সালের পর থেকে 80 হাজার তিব্বতের মানুষ ভারতে প্রবেশ করেছেন ৷ একইরকমভাবে বৌদ্ধ গুরু তথা ধর্ম প্রচারক 14 তম দলাই লামা নিজেও ভারতের শরণার্থী ৷

উাগান্ডায় 1972 সালে কিছু ভারতীয় নির্যাতনের স্বীকার হন এবং পরবর্তী সময় এক লাখের বেশি তামিল শ্রীলঙ্কা থেকে শরণার্থী হিসেবে থেকে যায় ৷ তবে নতুন আইনে এই সব শরণার্থীদের নিয়ে কোনও সমস্যা নেই, সব সমস্যা ওই তিন মুসলিম রাষ্ট্রের শরণার্থীদের নিয়েই ৷ দেশভাগের সময় পশ্চিম সীমান্তবর্তী এলাকায় মানুষগুলির নির্যাতনের সম্মুখীন হন ৷ বাধ্য হয়ে তাঁরা ভারতে শরণার্থী হিসেবে প্রবেশ করেন ৷ যেখানে শিখ এবং হিন্দুরা তাদের স্থান বদল করে নিয়েছেন, সেখানে মুসলিমরা পরবর্তী কালে ফিরে গেছেন ৷ তবে পূর্ব সীমান্তবর্তী এলাকার অবস্থা ছিল ভয়ঙ্কর ৷ পরবর্তীতে পরিস্থিতি বেশ কিছুটা পরিবর্তন হয়ে যায়৷ পূর্ব পাকিস্তানের এবং বাংলাদেশের এক লাখের বেশি মানুষ ভারত এবং বাংলাদেশে তাঁদের আশ্রয় খুঁজে নিতে চান ৷ শরণার্থী হিসেবে এই অনুপ্রবেশ এখনও চলছে ৷

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী কিরেণ রিজিজু সংসদে জানিয়েছেন 2.40 কোটি অবৈধ অভিবাসী ভারতে রয়েছে ৷ এর মধ্যে বেশির ভাগই পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে, অসমও বাদ পড়েনি ৷ দেখা দেখে, 75 লাখ অবৈধ অভিবাসী পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে, বাকি অসম এবং ত্রিপুরায় ৷ এর মধ্যে অসমের স্থান দ্বিতীয় ত্রিপুরা তৃতীয়৷ জাতীয় রাজধানী অঞ্চলে 7-8 লাখ অবৈধ অভিবাসীদের দেখা গেছে ৷ এখান থেকে তারা উত্তরপ্রদেশ, কেরালা এবং হায়দরাবাদে ছড়িয়ে পড়ে ৷ এটা প্রথম থেকেই দেখা গেছে যে, অসম প্রথম থেকে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে ৷ অভিবাসীদের মধ্যে হিন্দুর পাশাপাশি মুসলিমদের সংখ্যাও প্রতি নিয়ত বেড়ে চলেছে৷ এই সংখ্যাটা 25 লাখ থেকে বেড়ে 35 লাখ হয়ে গেছে ৷ তাদের নিজস্ব জনসংখ্যা 50 শতাংশ হ্রাস পাওয়ার পর অসমের মানুষ জন তাঁদের মাতৃ ভাষাকে রক্ষা করতে প্রতিবাদ-আন্দোলন শুরু করে ৷

ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব, কেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি, ন্যাশনাল রিসার্চ অব সিটিজেন্স., আন্দোলনের জেরে 19 লাখ অবৈধ অভিবাসীকে চিহ্নত করা গেছে এবং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ৷NRC তৈরির সময়ই অহমিয়াদের পরিচয় লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে অনিয়মের বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ সামনে এসেছিল ৷ পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সমস্যা কিন্তু পুরোপুরি আলাদা ৷বিপুল পরিমান বেআইনি অভিবাসন ঘটেছিল বাংলায়, BJP তার রাজনৈতিক স্বার্থে পুরো বিষয়টাকে নিজের কাজে লাগায় ৷সংখ্যালঘুর জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান কারণ হল এই বেআইনি অভিবাসন, দাবি BJP-এর ৷ 1950 সালে বাংলায় মুসলিম জনসংখ্যা ছিল 20 শতাংশ, সেখানে 2011 সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে 27 শতাংশে ৷

অভিযোগ ওঠে, বাম এবং তৃণমূল কংগ্রেস বিষয়টি লুকিয়ে রেখেছিল, পরবর্তী সময় নিজেদের প্রচারের জন্য বিষয়টির প্রতিবাদ জানায় ৷ পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ এই ধরনের সমস্যা মেটানোর বিষয়ে সদর্থক পদক্ষেপ করনি, তারা ভাবেনি একই সংস্কৃতি এবং ভাষার মানুষদের কী ভাবে সংগঠিত করা যায় তা নিয়ে ৷ ত্রিপুরার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, 1951 থেকে 2011 সালের মধ্যে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে ৷ যেখানে 1951 সালে ছিল 60 শতাংশ সেখান থেকে 2011 সালে সংখ্যাটি কমে দাঁড়িয়েছে 31 শতাংশে ৷ স্বাভাবিক ভাবেই অবৈধ অভিবাসন সংক্রান্ত অভিযোগ মানতে রাজি নয় ত্রিপুরা ৷

উপরের আলোচনা থেকে বুঝতে অসুবিধা নেই কেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পেশ করার পর পূর্ব ভারতের অনেক সাংসদ তা সমর্থন করেছিলেন ৷ পূর্ব ভারতের অসম (তিনটি বিশেষ এলাকা ছাড়া) এবং ত্রিপুরা (কিছু অতি আদিবাসী এলাকা ছাড়া ), মেঘালয়ের রাজধানী শিলং এই আইনে অধীন চলে এসেছে ৷ আর সে কারণেই এই আইনের এত বিরোধিতা এই সকল রাজ্যে ৷

স্থায়ীকরণের ক্ষেত্রে সমস্যা

পূর্ব ভারতের মধ্যে অসম এবং ত্রিপুরায় অভিবাসন অনেক বেশি ৷ ত্রিপুরায় বাঙালির সংখ্যা বেশি ৷ অন্যদিকে, 1985 সালে যে আইন হয়েছিল, 35 বছর কেটে গেলেও এখনও পুরোপুরিভাবে তা অসমের সর্বত্র কার্যকর হয়নি ৷ বলা ভালো কার্যকর করা সম্ভব হয়নি ৷ সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপের পর 19 লাখ অভিবাসীদের চিহ্নিত করা গেছে ৷ এর মধ্যে ৫-6 লাখ হিন্দু রয়েছেন বলেও খবর ৷ এটাই অসমে ক্ষেভের সব থেকে বড় কারণ ৷ তাঁরা ভাষা-ধর্ম নিয়ে সমস্যায় কারণেই আজ আন্দোলনের পথে ৷ এমনকী, যখন প্রধানমন্ত্রী সেখানকার মানুষদের পাশে থাকার কথা বলছেন, তাঁদের আশা দিচ্ছেন, তারপরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে না, সেখানকার মানুষগুলোকে খুশি করতে পারছেন না ৷

এটা ভাবা ঠিক নয়, এই আন্দোলন-প্রতিবাদ BJP-র বিরুদ্ধে হচ্ছে ৷ আসলে বিষয়টি নিয়ে কোনও রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধেই তেমন ভাবে কিছু বলার মতো পরিস্থিতি নেই ৷ ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে তাদের যে কোনও ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই, এটা সেখানকার মানুষদের বোঝানোর জন্য অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে হবে ৷ পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি কিন্তু পুরোপুরি আলাদা ৷ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিবাসীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়ে সদর্থক পদক্ষেপ করছেন ৷ একই পথে পা বাড়িয়েছে কেরল, পঞ্জাব এবং মধ্যপ্রদেশও ৷

আঞ্চলিক দলগুলি এই সব মানুষের চাহিদা পূরণ করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করছে, আর এখানেই জাতীয় দলগুলির সঙ্গে তাদের অবস্থানগত পার্থক্য ৷তারা পশ্চিমবঙ্গ এবং অসমের ক্ষেত্রে ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে ৷ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই সমস্যাকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে ৷ আসলে, মতাদর্শের বাইরে গিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে একটা সদর্থক পদক্ষেপ করতে হবে, আর এর মাধ্যমেই এক মাত্র সমস্যার সমাধান সম্ভব ৷

ABOUT THE AUTHOR

...view details