আর দু'মাস পর পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে বিধানসভা নির্বাচন । বিধানসভা নির্বাচন যখন একেবারে দরজায় কড়া নাড়ছে, তখন কেন্দ্রীয় বাজেটে সেই সব রাজ্যের ভোটারদের কিছুটা খুশি করার ভাবনাটা যথেষ্ট প্রলুব্ধ করে । প্রায় তেমনটাই করতে দেখা গেল কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনকে । সোমবার পেশ করা বাজেটে অর্থমন্ত্রীর একাধিক ঘোষণা অসম এবং পশ্চিমবঙ্গে যেমন বিজেপি-র আত্মবিশ্বাস বাড়াল ঠিক তেমনই তামিলনাড়ু এবং কেরালার মতো রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলিতে আশার আলো দেখাল ।
বাজেট নিয়ে তাঁর প্রথম মন্তব্যে এ কথা স্বীকার করে খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বললেন যে, এবারের কেন্দ্রীয় বাজেটে কিছুটা বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে দক্ষিণ ও পূর্বের রাজ্যগুলিকে । ভোটমুখী 4 রাজ্যের প্রতি নির্মলা সীতারামনের এই 'বিশেষ গুরুত্ব' দেখিয়েছে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে ওই 4 রাজ্যে 2 লাখ 25 হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্রকল্প । 4 রাজ্যের মধ্যে আবার শুধুমাত্র তামিলনাড়ুর জন্যই বরাদ্দ হয়েছে সর্বোচ্চ 1 লাখ 3 হাজার কোটি টাকা । আগামী 5 বছরের জন্য এই রাজ্যে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে ওই টাকা ব্যবহার করা হবে ।
এই বিপুল পরিমাণ টাকায় কী হবে ? সে রাজ্যে তৈরি হবে একাধিক হাইওয়ে । এগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মাদুরাই-কোল্লাম করিডোর এবং চিত্তুর-থাটচুর করিডোর যা তামিলনাড়ুর বিভিন্ন জেলাকে প্রতিবেশী দুই রাজ্য কেরালা এবং অন্ধ্রপ্রদেশের বিভিন্ন এলাকার সঙ্গে যোগ করবে । সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল এই যে, বাজেট পেশের মাত্র 2 দিন আগে বিজেপি-র অন্যতম শীর্ষনেতা জেপি নাড্ডা তামিলনাড়ুতে এআইএডিএমকে-র সঙ্গে জোট বেঁধে আগামী নির্বাচনে লড়াই করার কথা ঘোষণা করেছেন । এর ফলে দুই দলের মধ্যে জোট গড়া নিয়ে যে টানাপড়েন চলছিল তা মিটে গেল বলেই মনে করা হচ্ছে ।
রাজ্যের পরবর্তী নির্বাচনে এনডিএ একসঙ্গে লড়াই করবে, এই ঘোষণা করে প্রাথমিক কাজ শুরুই করে দিয়েছিল এআইএডিএমকে । জোট বাঁধার বিষয়ে এত দিন পর্যন্ত কিছুটা গাছাড়া ভাব দেখাচ্ছিল বিজেপি-ই । এর একমাত্র কারণ হল, বিজেপি আশা করেছিল তামিল সুপারস্টার রজনীকান্ত নিজের রাজনৈতিক দল নিয়ে ভোটের ময়দানে নেমে পড়বেন । কিন্তু চলতি কোভিড অতিমারীর আবহ এবং নিজের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে তিনি রাজনীতিত নামা থেকে আপাতত পিছিয়ে গিয়েছেন ।
2021 সালের নির্বাচনের পর বিজেপি-র একটাই লক্ষ্য থাকবে, আর তা হল এআইএডিএমকে-র কনিষ্ঠ সহযোগী হিসাবে অন্তত কয়েকটি আসন জিতে রাজ্যে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়া । আর এর ফলেই কেন্দ্র এ কথা বোঝাতে মরিয়া যে তারা দক্ষিণের এই রাজ্য সম্বন্ধে কতটা চিন্তিত । অন্তত বিজেপি-র অন্দরের খবর তেমনটাই ৷ 19 জানুয়ারি তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এডাপ্পাডি কে পালানিস্বামী (ইপিএস) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করে একগুচ্ছ দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি দেন । দাবি জানান কেন্দ্রীয় বাজেটে বিশেষ কিছু ঘোষণার ।
ইপিএস-এর এইসব দাবির মধ্যে থেকে তাই বাজেটে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমনের কিছু ঘোষণা একেবারেই আশ্চর্য করে না । প্রসঙ্গত, আগামী 14 ফেব্রুয়ারি তামিলনাড়ু সফরে এসে একটি প্রকল্প উদ্বোধনের পরিকল্পনাও রয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ।
2021-22 সালেই 277 কিমি দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়ে চেন্নাই-সালেম করিডোর তৈরি করতে বিশেষ ভাবে আগ্রহী খোদ ইপিএস । 2018 সালে এই প্রকল্পের কথা ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই এর প্রবল বিরোধিতা করেন স্থানীয় কৃষকরা । কিন্তু ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট এই মামলায় সরকারের পক্ষে রায় দিয়ে জমি অধিগ্রহণের বিজ্ঞপ্তি জারির নির্দেশ দেয় । এই অর্থবর্ষেই 278 কিমি দীর্ঘ বেঙ্গালুরু-চেন্নাই এক্সপ্রেসওয়েরও প্রাথমিক স্তরের কাজ শুরু হয়ে যাওয়ার কথা । এই প্রকল্পের নির্মাণপর্ব শুরু হবে 2021-22 অর্থবর্ষে ।
118.9 কিমি দীর্ঘ চেন্নাই মেট্রোর দ্বিতীয় পর্যায়ের 63 হাজার 246 কোটি টাকার মধ্যে কেন্দ্রের ভাগের টাকাও দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নরেন্দ্র মোদি সরকার । নিজের বাজেট বক্তৃতায় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেন, তামিলনাড়ুতে একটি বহুমুখী পার্ক তৈরি করা হবে। এই পার্কের মাধ্যমে সমুদ্র সৈকতে চাষকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। এর মাধ্যমে বড় মাত্রায় কর্মসংস্থান এবং অতরিক্ত আয়ের ব্যবস্থা করা হবে।
কোচি, বিশাখাপত্তনম, পারাদ্বীপ এবং পেটুয়াঘাটের সঙ্গে চেন্নাই বন্দরও 5টি প্রধান মৎস্য বন্দরের অন্যতম । এরই পাশাপাশি নাগাপাট্টিনম জেলার ভেল্লাপাল্লামে আরও একটি মৎস্য বন্দরের দাবি করেছে তামিলনাড়ু সরকার । কেরালার মধ্য দিয়ে যাওয়া মুম্বই কন্যাকুমারী করিডর থেকেও তামিলনাড়ু পরিকাঠামোগত ভাবে সুবিধা পাবে । 600 কিমি দীর্ঘ এই পথ দেশের পশ্চিম তট বরাবর যাবে । বেশ কয়েক বছর তৃণমূল স্তরে কাজ করেও এখনও পর্যন্ত কেরলে নিজেদের অস্তিত্ব বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে বিজেপি । প্রতিবারই নির্বাচনের পর দেখা যায়, রাজ্যের জনমত গিয়েছে হয় বাম জোটের দিকে নয়ত কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোটের দিকে । এবার যেমন স্থানীয় নির্বাচনে ভাল ফল করে বাম দলগুলির জোট আশা করছে রাজ্যে ফের ক্ষমতায় ফেরার ।
তবে এবারের কেন্দ্রীয় বাজেট দেখেছে কেরালার প্রতি বিজেপি-র দায়বদ্ধতা । কোচি মেট্রোকে আরও সাড়ে 11 কিমি বাড়ানোর কথা ঘোষণা করা হয়েছে । তার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে 1957 কোটি টাকা । কোচির সমুদ্র বন্দরকেও একটি প্রধান ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার কথা ঘোষণা করা হয়েছে । ঊর্ধ্বসীমা 5 কোটি থেকে 10 কোটি করে অনাবাসী ভারতীয়দের দ্বৈত করের হাত থেকেও অনেকটা রেহাই দিয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী । এই ঘোষণার ফলে ওই রাজ্যের প্রায় 30 লাখ অনাবাসী ভারতীয়ের কাছে বিজেপি-র গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে ।
পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানোর বিষয়ে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী পদ্ম শিবির । ওই রাজ্যের জন্য কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বাজেটে 25 হাজার কোটি টাকার সড়ক পরিকাঠামো প্রকল্পের ঘোষণা করেছেন । এই টাকা কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি সড়কের উন্নয়ন করা হবে । শিলিগুড়ি হল ওই রাজ্যের উত্তর অংশের, অর্থাৎ উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় শহর । উত্তরবঙ্গে বিজেপি 2019 সালের লোকসভা নির্বাচনে 8টি আসনের মধ্যে 7টিতেই জয় লাভ করেছিল । সীতারমন আরও ঘোষণা করেন, 675 কিমি রাস্তা তৈরি করা হবে । এর মধ্যে রয়েছে সে রাজ্যের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার খড়্গপুর থেকে বিজয়ওয়াড়া পর্যন্ত এবং হুগলি জেলার ডানকুনি থেকে বিহারের গোমো পর্যন্ত একটি করে ফ্রেট করিডরের ঘোষণা ।
পশ্চিমবঙ্গ এবং অসমের চা শিল্পের উন্নতির জন্য এক হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্যাকেজেরও ঘোষণা করা হয়েছে কেন্দ্রীয় বাজেটে । অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একথা একেবারেই অস্বীকার করেছেন যে বাজেটের এইসব ঘোষণার ফলে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে কোনও বড় প্রভাব পড়বে । তবে একথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে 10 বছর রাজ্যে ক্ষমতায় থাকার পর মমতা তাঁর কেরিয়ারের কঠিনতম নির্বাচনের মুখোমুখি হতে চলেছেন ।
বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালের নেতৃত্বে অসমে ফের ক্ষমতায় ফেরার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী বিজেপি নেতৃত্ব। সে রাজ্যের জন্য আগামী 3 বছরে সড়ক পরিকাঠামোয় 34 হাজার কোটি টাকার এক হাজার তিনশো কিমি জাতীয় সড়কের কথা ঘোষণা করেছেন নির্মলা। এই মুহূর্তে সে রাজ্যে 19 হাজার কোটি টাকার জাতীয় সড়কের কাজ চলছে। এই টাকা তার সঙ্গেই যোগ হবে। এ বারের নির্বাচনে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে চলা পরিকাঠামো প্রকল্পগুলিই বিজেপি-র প্রধান হাতিয়ার।