ভোপাল, 3 ডিসেম্বর : 1984 সাল । সেদিনও রবিবার ছিল । ডিসেম্বরের শুরুতেই জাঁকিয়ে শীত পড়েছিল ভোপালে । আলো ঝলমলে সন্ধ্যায় হঠাৎই অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করেন মানুষজন । কয়েকজন হাঁপাতে শুরু করেন । কয়েকজন বমিও করছিলেন । তারপর শুরু হয় মৃত্যুলীলা । মিথাইল আয়সোসয়ানাইটের বিষবাষ্পে ঢেকে গেছিল শহর । বাকিটা মধ্যপ্রদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেদনাদায়ক অধ্যায় । ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডি । সেই দুঃস্বপ্নের রাতের 35 বছর আজ । তৎকালীন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডি কে সতপথির কথায় উঠে এল সেদিনের অজানা কথা । যা আজও সরকার-প্রশাসনের ভূমিকাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায় । চিকিৎসক সতপথির বক্তব্য, 20 বছর ধরে ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডির নমুনা আগলে রেখেছিলেন তিনি । ভেবেছিলেন এগুলি পরীক্ষা করে ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়া যাবে । মোকাবিলা করা যাবে ভবিষ্যতের কোনও পরিস্থিতির । কিন্তু একবারও পরীক্ষা করে দেখেনি সরকার ।
1984 সালের 2-3 ডিসেম্বর । ইউনিয়ন কার্বাইড প্ল্যান্ট থেকে গ্যাস লিক হয়ে কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল । আক্রান্ত হয়েছিল প্রায় 5 লাখ মানুষ । চিকিৎসক সতপথি তখন ভোপালের হামিদিয়া হাসপাতালের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন । 3 ডিসেম্বর সকালে ফোন আসে । হঠাৎই খবর পান, ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনায় শয়ে শয়ে মানুষে ভরে গেছে হাসপাতাল । অটোপসির জন্য ক্রমেই তাঁদের ডিপার্টমেন্টের উপর চাপ বাড়ছিল । সতপথি বলেন, "কয়েকজন হাঁফাচ্ছিল,কয়েকজন বমি করছিল এবং বেশিরভাগই কাঁদছিল । বেশ কয়েকজনের মৃত্যুও হয়েছিল । ওই দিনই মোট 876 টি অটোপসি হয়েছিল । অর্থাৎ ঘণ্টায় প্রায় 36টি অটোপসি করা হয়েছিল ।"
ইউনিয়ন কার্বাইড প্ল্যান্ট থেকে গ্যাস লিক হয় এরপর কেটে গেছে অনেক বছর । কিন্তু ভবিষ্যতের ভয়ঙ্কর পরিণামের কথা মাথায় রেখে গবেষণা চালিয়ে যান সতপথি । কুড়ি বছর ধরে ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডির শিকার হওয়া মানুষের নমুনা আগলে রাখেন । আশায় বুক বেঁধেছিলেন । ভেবেছিলেন তাঁর এই পরিশ্রম সার্থকরূপ পাবে একদিন । অটোপসির ওই নমুনাগুলি যেন সরকার খতিয়ে দেখে, পরীক্ষা করে সেজন্য একাধিকবার আবেদন জানিয়েছেন তিনি । বহু সরকারি সংস্থাকে চিঠিও লিখেছেন । আশায় ছিলেন, হয়ত সরকার নমুনাগুলি খতিয়ে দেখবে । এই পরীক্ষা থেকে সতর্ক হবে । ভবিষ্যতে যাতে এইরকম ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যায় তার জন্য আগাম পদক্ষেপ নিতে পারবে । কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি । সদিচ্ছা দেখিয়ে জানতেও চায়নি কী ভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন ভোপালবাসীরা ।
চিকিৎসক সতপথি বলেন, "20 বছর ধরে অপেক্ষা করেছি । -20 ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতায় নমুনাগুলিকে সংরক্ষণ করাছিল । তখন আমাদের কাছে কোনও ধারণাই ছিল না যে, কী ভাবে মিথাইল আইসো সায়ানাইট শরীরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে । আমরা প্রত্যেকটি রক্ত, এমন কী কলারও নমুনা নিয়েছিলাম । আমি জানতাম ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের তদন্তে এই নমুনাগুলি অপরিহার্য ছিল । বুঝতে পেরেছিলাম যারা বেঁচে আছে তাদের চিকিৎসায় এই পরীক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু 2006 সালে একবার সারাদিন বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে হামিদিয়া হাসপাতাল । নষ্ট হয়ে যায় সমস্ত নমুনা । অনেক চেষ্টা করেছি । চিঠি দিয়েছি সরকারি সংস্থাগুলিকে । কিন্তু কেউ আসেনি ।"
আক্রান্ত হয়েছিল প্রায় 5 লাখ মানুষ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হয়ত সব চাপা পড়ে গেছে । নমুনাগুলি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর আর সেভাবে কেউ গুরুত্বও দেয়নি । কিন্তু একটা ক্ষোভ, ব্যর্থতা যেন আজও তাড়া করে বেড়ায় চিকিৎসক সতপথিকে । কে জানে ? এই নমুনাগুলি হয়ত অনেক তথ্য দিতে পারত । যা ভবিষ্যতের কোনও ঘটনায় সাহায্য করত প্রশাসনকে ।