প্রস্তাব
চলতি বছরের 27 জানুয়ারি অন্ধ্রপ্রদেশ বিধানসভার তরফে সংসদে বিধান পরিষদ (APLC) বাতিল ঘোষণা করার প্রস্তাব করা হয় । সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়টি হল, রাজ্য বিধানসভার উচ্চকক্ষ বাতিলের প্রস্তাব প্রথম দিয়েছিলেন বর্তমান প্রধান বিরোধী দল তেলুগু দেশম পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এন টি রামা রাও । তিনি 1985 সালে এই বিধান পরিষদ বাতিল করতে সমর্থও হয়েছিলেন । পরে 2007 সালে বিধান পরিষদ ফিরিয়ে এনেছিলেন ওয়াই এস রাজশেখর রেড্ডি অর্থাৎ রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী জগন মোহন রেড্ডির বাবা ।
এই প্রস্তাবের উপর এক আলোচনাসভায় জগন মোহন রেড্ডি বলেন, বিধান পরিষদ আর সাধারণ মানুষের কোনও কাজে লাগে না । এটি একটি সাদা হাতিতে পরিণত হয়েছে । প্রস্তাবের সমর্থনে তিনি দাবি করেন, বিধান পরিষদ রাজ্যের উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করছে । এটি রাজ্যের উন্নতি অর্থাৎ অন্ধ্রপ্রদেশ ডিসেন্ট্রালাইজেশন অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট অব অল রিজিয়নস (APDIDAR) বিল এবং অন্ধ্রপ্রদেশ ক্যাপিটাল রিজিয়ন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (APCRDA) প্রত্যাহার সংক্রান্ত বিলের মাঝখানে এসে দাঁড়াচ্ছে । দ্বিতীয় এই বিলটি রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এন চন্দ্রবাবু নাইড়ু এনেছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশের নতুন রাজধানী অমরাবতীকে সাজিয়ে তোলার জন্য । প্রথম বিলের উদ্দেশ্য উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণের মতো এক অভিনব পরিকল্পনার রূপায়ণ । একটি নয়, রাজ্যে তিনটি রাজধানী চান জগন মোহন রেড্ডি । প্রশাসনিক রাজধানী বিশাখাটনম, বিচারবিভাগীয় রাজধানী কুর্নুল ও আইনবিষয়ক রাজধানী অমরাবতী । এই বিল দু’টি বিধান সভায় পাশ হওয়ার পর তা সিলেক্ট কমিটির কাছে পাঠিয়েছিল বিধান পরিষদ ।
বিভিন্ন রাজ্যে বিধান পরিষদ
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অন্ধ্রপ্রদেশ-সহ দেশের বাকি রাজ্যগুলির বিধান পরিষদের একটা বর্ণময় ইতিহাস আছে । 1956 সালে অন্ধ্রপ্রদেশ বিধানসভাতে পাশ হওয়া প্রস্তাবের ভিত্তিতে 1958 সালে তৈরি হয় বিধান পরিষদ । 1985 সালে এন টি রামা রাও এই পরিষদ বাতিল করেন । তাঁর যুক্তি ছিল, এই পরিষদ একটি অনির্বাচিত সংস্থা, যার নাক গলানোর ফলে গুরুত্বপূর্ণ এবং রাজ্যের উন্নতির স্বার্থে করা পদক্ষেপ থমকে যাচ্ছে । তিনি আইন পরিষদ নিয়ে সেদিন যা বলেছিলেন, সাড়ে তিন দশক পর প্রায় সেই একই যুক্তি দেন জগন মোহন রেড্ডি । একবার ব্যর্থ হলেও এই পরিষদ 2007 সালে ফিরিয়ে এনেছিলেন ওয়াই এস আর রেড্ডি ।
2019 সালে সালে জম্মু ও কাশ্মীরের পুনর্গঠনের পর দেশের মাত্র ছ’টি রাজ্যে আইন পরিষদ রয়েছে । সেগুলি হল অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, তেলঙ্গানা এবং উত্তরপ্রদেশ । আইন পরিষদ গঠনের জন্য 1956 সালে মধ্যপ্রদেশ বিধানসভায় আইন পাশ হয় । কিন্তু সেই আইন কার্যকর করার জন্য নোটিশ আজ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি । রাজস্থান ও অসমে আইন পরিষদ তৈরির প্রস্তাব এখনও সংসদের বিবেচনাধীন ।
প্রাথমিকভাবে চালু হলেও স্বাধীনতার পর 1970 সালে পঞ্জাব, 1986 সালে তামিলনাড়ু ও 1969 সালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিধান পরিষদের বিলোপ ঘটে । 2010 সালে বিধান পরিষদের পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে প্রস্তাব পাশ হয় তামিলনাড়ু বিধানসভায় । এই বিষয়ে সংসদে আইন পাশ হয় । কিন্তু তা কার্যকর করার জন্য নোটিশ জারি হওয়ার আগেই রাজ্যে ক্ষমতা বদল হয় এবং নতুন সরকার বিধান পরিষদের বিলুপ্তি চেয়ে আবেদন করে । 2012 সালে এই প্রস্তাব রাজ্যসভায় পেশ হয় । সেই কারণে তামিলনাড়ুর এই মুহূর্তে কোনও আইন পরিষদ নেই ।
সাংবিধানিক বিধান
বিভিন্ন রাজ্যে বিধান পরিষদের এই ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার অন্যতম কারণ, সংবিধানে এই প্রতিষ্ঠানের দুর্বল অবস্থান । সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার মতো রাজ্যস্তরে বিধান পরিষদ থাকা আবশ্যক নয় । সংবিধানের 169 নম্বর ধারার প্রথম উপধারা অনুযায়ী, কেন্দ্র চাইলে কোনও রাজ্যে বিধান পরিষদের গঠন বা বিলোপ ঘটাতে পারে । তবে সেক্ষেত্রে সেই রাজ্যের বিধানসভায় বিল পাশ হতে হবে । এই বিল পাশ করাতে হবে বহুমতের ভিত্তিতে । ভোটদানের সময় বিধানসভার অন্তত দুই তৃতীয়াংশ সদস্যকে উপস্থিত থাকতেই হবে । তবে, কেন্দ্র ইচ্ছা করলে রাজ্যের প্রস্তাব মানতেও পারে, আবার না মানতেও পারে । যেহেতু 168 নম্বর ধারায় সেই সব রাজ্যের নাম নথিভুক্ত রয়েছে, যাদের বিধান পরিষদ রয়েছে, প্রতিবার কোনও রাজ্যে আইন পরিষদ তৈরি হলে বা বিলুপ্ত হলে এই ধারায় বদল আনতে হয় ।
আইন প্রণয়ন বা বিল পেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিধান পরিষদ আর রাজ্যসভা প্রায় সমার্থক । দুই ক্ষেত্রেই একমাত্র অর্থবিল বাদে কোনও বিলের জন্যই দুই কক্ষের অনুমতির প্রয়োজন হয় না । কিন্তু আইন সংশোধন বা বাতিলের বিষয় মাথায় রাখলে বলা যায়, দুই কক্ষের ক্ষমতায় তফাৎ বিপুল । বিধানসভায় পাশ হওয়াৱ পর যদি কোনও বিল বিধান পরিষদ খারিজ করে, বা বিলে সংশোধনী খারিজ করে বা বিল পেশ হওয়ার তিন মাস পর্যন্ত কোনও পদক্ষেপ না করে, তা হলে ফের সেই বিল বিধানসভায় পাশ করিয়ে তা বিধান পরিষদে পাঠাতে পারে সরকার । যদি ফের তা পরিষদ খারিজ করে বা সংশোধনী এনে বিধানসভায় ফেরত পাঠায় বা পরবর্তী এক মাস কোনও পদক্ষেপ না করে, তা হলে দ্বিতীয় বার বিধানসভায় পাশ হওয়া বিলটি দুই কক্ষেই পাশ হওয়া বিল হিসাবে গণ্য হবে । অর্থাৎ, কোনও বিল নিয়ে আপত্তি থাকলে তা মেটাতে দুই কক্ষের মিলিত সভার কোনও বিকল্প আইনে নেই ।
সংসদ চাইলে বিধান পরিষদের ক্ষমতা বাড়াতে বা কমাতে পারে । রাজ্যসভার ক্ষেত্রে সেই বিকল্প ক্ষমতা সংবিধানেই দেওয়া আছে। রাজ্যসভার সদস্যদের মতো বিধান পরিষদের সদস্যরা রাষ্ট্রপতি বা উপ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দিয়ে অংশ নিতে পারেন না ।