COVID-১৯ মহামারী নিয়ে বিশ্বজুড়ে চিন-বিরোধী আবেগ তৈরি হওয়ার মধ্যেই, গত মে মাসে হংকংয়ে কঠোর নিরাপত্তা আইন লাগু করেছে চিন । 2019 সালের মাঝামাঝি থেকে হংকয়ে গণতন্ত্রকামী আন্দোলন হঠাৎ করেই হিংসাত্মক চেহারা নিয়েছে। বিদেশি শক্তির সঙ্গে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে শয়ে শয়ে প্রতিবাদীর ওপর অত্যাচার এবং জেলবন্দি করা হয়েছে।
হংকংয়ের বিক্ষোভকারীরা চান যে চিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ব্রিটেন-চিন চুক্তিকে মর্যাদা দিক। এই চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটেন 1997 সালের 1 জুলাই শান্তিপূর্ণভাবেই হংকংকে চিনের হাতে তুলে দিয়েছিল। পরিবর্তে চিন কথা দিয়েছিল যে তারা আরও 50 বছর, অর্থাৎ 2047 সাল পর্যন্ত বর্তমান ব্রিটিশ পুঁজিবাদী ও আইনি ব্যবস্থা চালু রাখবে ।
কিন্তু এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে চিন ব্রিটেনের সঙ্গে করা চুক্তিকে সম্মান দিতে রাজি নয়। এর ফলে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক কেন্দ্র এবং মুক্ত বন্দর হিসেবে হংকংয়ের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
এর জেরে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে 8 শতাংশ অ-চিনা ইউরোপীয়, এশীয় ও ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে হংকংয়ে দশকের পর দশক ধরে থাকা গোষ্ঠীগুলো দেরি হওয়ার আগেই অন্যত্র চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।
হংকংয়ের দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে সিঙ্গাপুর (আরেকটি অগ্রণী আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক কেন্দ্র), যার অবস্থান মালাক্কা প্রণালীর পূর্বদিকের প্রবেশপথে। মালাক্কা প্রণালীর পশ্চিম প্রবেশপথে রয়েছে ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। সবমিলিয়ে 5 হাজার 72টি দ্বীপ সহ, এই দ্বীপপুঞ্জের মোট এলাকা 8 হাজার 259 বর্গকিলোমিটার।
সমস্ত দ্বীপের মধ্যে নিকোবরই মালাক্কা প্রণালীর পশ্চিমদিকের প্রবেশপথের সবথেকে কাছে। এর পাহাড়ি এলাকা দিয়ে পাঁচটি নদী বয়ে চলার ফলে, যথেষ্ট মিষ্টি জলও রয়েছে। 1044 বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপ সিঙ্গাপুরের (720 বর্গকিমি) থেকে বড়, কিন্তু হংকংয়ের ( বর্গকিমি) থেকে সামান্য ছোট।
ঘটনাচক্রে ভারত 1962 সালে চিনের কাছে যুদ্ধে হারার পর, 330 জন প্রাক্তন সেনাকর্মীর পরিবারকে নিকোবর দ্বীপে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তাঁদের জন্য পরিকাঠামো নির্মাণ করেছিল বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন।
প্রতিরক্ষার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের পাশাপাশি, নিকোবর দ্বীপের ব্যবসায়িক সম্ভাবনাও অনেকদিন আগে লক্ষ্য করা হয়েছিল। 1970 সালে একটি বিশদ রিপোর্টে ভারতের ট্রেড প্রোমোশন অর্গানাইজেশন (টিপিও) বলেছিল: যখন 1997 সালে ব্রিটিশরা হংকং ছেড়ে চলে যাবে এবং হংকং চিনের মূল ভূখণ্ডের অন্তর্ভূক্ত হবে, অ-চিনা ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো একইরকমের আরেকটি জায়গা খুঁজতে পারে। যদি নিকোবরকে মুক্ত বন্দর হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তাহলে এধরণের ব্যক্তিদের আকর্ষণ করার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।
বলতে গেলে, হংকংয়ের মোট 75 লক্ষ জনসংখ্যার বেশিরভাগই চিনা। কিন্তু 8 শতাংশ অ-চিনা জাতিগোষ্ঠী রয়েছে যাদের উৎস ইউরোপ, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ফিলিপিন্স। ভারতীয় রয়েছেন প্রায় 22 হাজার, যাঁদের বেশিরভাগই অত্যন্ত সফল আন্তর্জাতিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত।
1970 সালের টিপিও রিপোর্ট, যা তখন কার্যকর হয়নি, সেটাই এখনকার দেওয়াল লিখন বলে প্রমাণিত হয়েছে। হংকংয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের জেরে, কঠোর জাতীয় নিরাপত্তা আইন মেনে চলা বহু অ-চিনা ব্যবসায়ী গোষ্ঠী মরিয়া হয়ে অন্য আরেকটা জায়গা খুঁজছে যা আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে অবস্থিত এবং যেখানে মুক্ত বন্দর আছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে 10 অগাস্ট আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের জন্য সমুদ্রের তলা দিয়ে অপটিক্যাল ফাইবারের যে প্রকল্প প্রধানমন্ত্রী মোদি উদ্বোধন করেছেন, তার অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। 1224 কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পে চেন্নাই থেকে দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত 2312 কিলোমিটার দূরে ব্রডব্যান্ড যোগাযোগ স্থাপিত হবে।
10 অগাস্ট প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতারও অত্যন্ত তাৎপর্য রয়েছে। তিনি বলেন যে দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত অপটিক্যাল ফাইবার যোগাযোগ ভারতের ‘পূর্বে পদক্ষেপ’ নীতিকে নতুন মাত্রা দেবে। দ্বীপপুঞ্জের বিমানবন্দরগুলোর উন্নয়ন করা হবে এবং আরও এয়ার স্ট্রিপ তৈরি করা হবে। এই এলাকা দিয়ে চলাচল করা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপোতগুলির রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতির কাজেও এই দ্বীপপুঞ্জকে ব্যবহার করা হবে।
প্রসঙ্গত, সংলগ্ন মালাক্কা প্রণালী হল বিশ্ববাণিজ্যের ব্যস্ততম সমুদ্রপথগুলোর মধ্যে একটা। দক্ষিণ চিন সাগর থেকে মালাক্কা প্রণালী দিয়ে বেরিয়ে, অথবা তার বিপরীত পথে, সারাবছরে প্রায় 70 হাজার জাহাজ চলাচল করে। বিশ্বের 25শতাংশ তেল এই পথ দিয়ে পরিবহণ করা হয়, প্রতিদিন প্রায় 150 লক্ষ ব্যারেল তেল। এর পাশাপাশি বিভিন্ন অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী নিয়ে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বহু দেশের জাহাজ মালাক্কা প্রণালী দিয়ে যাতায়াত করে, যার জেরে এর কৌশলগত গুরুত্ব বেড়েছে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক জাহাজ মেরামতির কাজে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে ব্যবহার করার যে পরিকল্পনার কথা প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছে, তার থেকে এই দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে ভারতের পরিকল্পনার একটা আভাস মেলে। বিশেষ করে ভারত-চিন সম্পর্কে শীতলতার পর, ভারত শেষপর্যন্ত 70 সালের টিপিও রিপোর্টের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছে।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে, আন্দামান-নিকোবরে যে উন্নয়নের কাজ হচ্ছে, তার মধ্যেও একটা প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আন্দামান ও নিকোবরের প্রশাসন (একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল)2019 সালের শেষের দিকে একটি আন্তর্জাতিক টেন্ডার প্রক্রিয়ার ঘোষণা করেছে, যার লক্ষ্য নিকোবর দ্বীপে একটি কন্টেনার ট্রান্স-শিপমেন্ট টার্মিনাল (সিটিটি) তৈরি করা। 10 হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পের প্রথম দফার কাজ শেষ হবে 2025সালের মধ্যে। অলিখিতভাবে এই আন্তর্জাতিক টেন্ডারে চিনা সংস্থাগুলোর অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
কিন্তু নিকোবর দ্বীপকে মুক্ত বন্দর হতে গেলে সিটিটি হচ্ছে শুধু প্রথম ধাপ। এখানে সাধারণ ভারতীয় ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে একটা সম্পূর্ণ নতুন করব্যবস্থা রাখতে হবে। এর জন্য একে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ থেকে বার করে আনতে হবে এবং বিদেশমন্ত্রক এবং বাণিজ্যমন্ত্রকের যৌথ তদারকির আওতায় আনতে হবে। অন্যদিকে, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের বিপুল সামরিক গুরুত্বও রয়েছে। এই দ্বীপপুঞ্জ দক্ষিণ চিন সাগরের খুব কাছে অবস্থিত, যা এখন বিতর্কিত এলাকায় পরিণত হয়েছে। আমেরিকা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার পাশাপাশি, আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোও দক্ষিণ চিন সাগরে চিনের ক্রমবর্দ্ধমান আগ্রাসনে জোরালো আপত্তি জানিয়েছে।
আসিয়ানভুক্ত বহু দেশ, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, লাওস, কাম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম দক্ষিণ চিন সাগরে চিনের সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি বেড়ে চলায় উদ্বিগ্ন। ঘটনাচক্রে আগে থেকেই আন্দামান-নিকোবরের ক্যাম্পবেল বে-র কার্গো বন্দরের কাছে ভারতের নৌসেনার একটি এয়ারবেস রয়েছে।
ওয়াকিবহাল মহল জানিয়েছে, নিজেদের সামরিক ঘাঁটিগুলো শক্তিশালী করতে এবং কোয়াড-এর অন্তর্ভূক্ত আরও তিনটি দেশের সহযোগিতায় ভারত আন্দামান-নিকোবরে একটি যৌথ সামরিক ঘাঁটি নির্মাণে অত্যন্ত আগ্রহী।
‘কোয়াড’, অর্থাৎ কোয়াড্রিল্যাটেরাল সিকিউরিটি ডায়লগ হল আমেরিকা, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে একটি সামরিক সহযোগিতা, যার লক্ষ্য দক্ষিণ চিন সাগরে চিনের বেড়ে চলার আগ্রাসনের মোকাবিলা। কোয়াড-এর বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ হিসেবে, অগাস্ট মাস থেকেই চার দেশের বিদেশমন্ত্রীকা সপ্তাহে একবার ভার্চুয়াল বৈঠকে মিলিত হচ্ছেন।
আসলে কোয়াড আগে থেকেই ছোট ছোট পদক্ষেপ নিচ্ছিল। 2017 সালে ডোকলাম সংঘাতের সময় ভারত, জাপান ও আমেরিকা আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপে যৌথ সামরিক মহড়ার আযোজন করেছিল। লাদাখে চিনের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাতের মধ্যেই আমেরিকা তার পরমাণু শক্তিচালিত ইউএসএস নিমিটজকে দক্ষিণ চিন সাগরের মধ্যে দিয়ে পাঠিয়েছে এবং 20 জুলাই ভারতীয় নৌসেনার সঙ্গে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে মহড়ায় অংশ নিয়েছে।
ঘটনাচক্রে, আন্দামান ও নিকোবর হল ভারতের একমাত্র অংশ যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সাড়ে তিন বছর জাপানিদের অধীনে ছিল। ভারতের মতোই চিনের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাতে জড়িয়ে পড়া জাপান এই দ্বীপপুঞ্জের উন্নয়ন করতে আগ্রহ দেখিয়েছে।
কিন্তু সেক্ষেত্রে দ্বীপপুঞ্জকে মনোমত উচ্চতায় তুলে নিয়ে আসা একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, যেখানে অন্তত 12 থেকে 16 বছর লাগাতার কাজ করে যেতে হবে। যদি 2024-এর সাধারণ নির্বাচনের পর দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকে এবং তৎকালীন সরকার যদি দ্বীপপুঞ্জের উন্নয়নে একইরকম দায়বদ্ধ থাকে, তাহলে ণণসমস্ত সম্ভাবনা রয়েছে প্রধান মুক্তবাণিজ্য কেন্দ্র এবং কোয়াডভুক্ত দেশগুলির গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি হিসেবে এই দ্বীপপুঞ্জের উঠে আসার।