দিল্লি, 12 জুলাই : গোটা বিশ্ব বর্তমানে কোরোনার সঙ্গে মোকাবিলা করছে । এর সংক্রমণ গতবছর চিনের ইউহানে হয়েছিল ৷ এরই মধ্যে বেজিং দক্ষিণ চিন সাগরে নিজেদের আধিপত্যবাদী অবস্থান জারি রেখে আন্তর্জাতিক মহলের ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিয়ে চলেছে । এই দক্ষিণ চিন সাগরই হল সেই এলাকা, যেখানকার একাধিক দেশের সঙ্গে বেজিং আঞ্চলিক ক্ষমতা দখলের বিবাদে জড়িত । আর এ সব তখন হচ্ছে, যখন ইতিমধ্যেই ভারত এবং চিন পূর্ব লাদাখের কাছে সীমান্ত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে ৷ গত 45 বছরের মধ্যে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (LAC) এলাকায় এই প্রথম সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, যা নিয়ে বিশ্বে উদ্বেগও ছড়িয়েছে ।
গত সপ্তাহে চিনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (PLA) দক্ষিণ চিন সাগরে নৌবাহিনীর মহড়া শুরু করে দিয়েছে, জলে-স্থলে সমান কার্যক্ষম হামলার মাধ্যমে । প্যারাসেল দ্বীপের কাছে চিনের এই সাম্প্রতিক কার্যকলাপকে প্রতিরোধ করার জন্য অ্যামেরিকা দক্ষিণ চিন সাগরে তিনটি পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন এয়ারক্রাফ্ট নিয়োজিত করেছে ।
ভারত থেকে শুরু করে দক্ষিণ চিন সাগর এবং অন্যত্র, চিনের এই সাম্প্রতিক আধিপত্য বিস্তারকারী পদক্ষেপের প্রেক্ষিতে অ্যামেরিকার বিদেশ সচিব মাইক পম্পেও 8 জুলাই এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছেন, "হিমালয়ের পর্বতচূড়া থেকে শুরু করে ভিয়েতনামের এক্সক্লুসিভ জ়োন, সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ (জাপান সীমান্তলাগোয়া পূর্ব চিন সাগর) এবং তারও বাইরে বেজিং আঞ্চলিক বিবাদ তৈরি করার চেষ্টা করছে । পৃথিবীর কোনও দেশের চিনের এই দাদাগিরি মেনে নেওয়া উচিত নয় । দিনের পর দিন এমন চলতে দেওয়াও উচিত নয় ।"
এরপর বুধবার, প্রভাবশালী ইংরেজি সংবাদপত্র 'গ্লোবাল টাইমস', যা চিনের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র হিসাবে পরিচিত, এই নিয়ে বেজিংয়ের বক্তব্য তুলে ধরে জানায়, "তিন দিন ধরে দক্ষিণ চিনের গুয়াংডং প্রদেশের কাছে পাঁচটি অ্যামেরিকান সেনা রিকনেস্যান্স বিমান উড়ে বেড়াচ্ছে ।" রীতিমতো হুঁশিয়ারির সুরে গ্লোবাল টাইমস জানিয়েছে, "অ্যামেরিকান সেনার এই প্ররোচনার জবাবে PLA একাধিক প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিতে সক্ষম, যার মধ্যে অন্যতম অ্যামেরিকান বিমানের বিপরীতে ফাইটার জেট পাঠানো এবং তাদের চিনের আকাশসীমা থেকে বাইরে বের করে দেওয়া । নিজের ভাষাতেই অ্যামেরিকার রণকৌশলের যোগ্য জবাব দেবে চিন ।"
অবজ়ার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন নামক থিঙ্কট্যাঙ্কের মেরিটাইম পুলিশ ইনিশিয়েটিভের প্রধান অভিজিৎ সিংয়ের মতে, দক্ষিণ চিন সাগরে অ্যামেরিকার রণবহর পাঠানোর অর্থ আদপে বেজিংকে এই বার্তা দেওয়া যে ওই এলাকায় সে এভাবে একাধিপত্য চালিয়ে যেতে পারে না । ETV ভারতকে তিনি বলেছেন, "সাম্প্রতিক সময়ে ওই এলাকায় চিনের উপকূলবর্তী সেনার (অ-নৌ সেনাকর্মী) গতিবিধি বেড়েছে । তাদের আগের থেকে অনেক বেশি সেখানে দেখা যাচ্ছে ।"
আর এই কারণেই, তাঁর মতে, ASEAN দেশগুলি অ্যামেরিকা এবং জাপানের মতো দেশের সাহায্য চেয়েছে । জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অফ চাইনিজ় অ্যান্ড সাউথইস্ট এশিয়ান স্টাডিজ়-এ চাইনিজ় অ্যান্ড চায়না স্টাডিজ়ের অধ্যাপক বি আর দীপক মনে করেন, চিনের এই আধিপত্যবাদী আচরণ কিন্তু হঠাৎ করে ঘটেনি । বরং অনেক আগে থেকেই তা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল । তিনি বলেছেন, "1979 সাল থেকে চিনের মূল লক্ষ্য ছিল সংস্কার সাধন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন । 2012 সালের পর যখন শি চিনপিং প্রেসিডেন্ট হলেন, তখন থেকেই চিনের আত্মবিশ্বাস বাড়তে লাগল এবং এটি ক্রমশ নিজের একাধিপত্য বিস্তারের নীতি রূপায়িত করতে উদ্যোগী হল ।"
নিজের যুক্তির সপক্ষে বলতে গিয়ে দীপক ভারতের সঙ্গে চিনের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা এবং দক্ষিণ চিন সাগর দ্বীপ এলাকায় চিনের আঞ্চলিক অধিকারের মধ্যে একটি সমান্তরাল তুলনাও দিয়েছেন । তাঁর মতে, "প্রথমে চিন এলাকা নিজের বলে দাবি করল । পরে ফের সেই একই দাবি জানাল । তারপর সেনা মোতায়েন করে দাবি জোরালো করল আর তারপর এলাকার স্থিতিশীলতায় বদল আনল । আবার তারও পরে আন্তর্জাতিক মহলকে জোর গলায় এটা বোঝানোর চেষ্টা করল যে তাদের দাবি কতটা সঠিক ।"
কিন্তু বেজিংয়ের ক্ষেত্রে যা সমস্যা বাড়িয়ে তুলতে পারে, তা হল লাদাখের সীমান্ত সংঘর্ষের ঘটনার পর দক্ষিণ চিন সাগর এলাকায়, পরিকল্পনামাফিকভাবে ভারত নৌ-কার্যকলাপ বাড়ানোর চেষ্টা করবে । গত সপ্তাহে একটি অনলাইন ফোরামে ফিলিপিন্সের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডেলফিন লোরেঞ্জানা এই নিয়ে বলেছেন, "দক্ষিণ চিন সাগরে অন্য কোনও দেশের রণতরী চলাচল বা অন্য কোনও কাজ করার ক্ষেত্রে আমরা হস্তক্ষেপ করি না । দক্ষিণ চিন সাগর এলাকা ধরে ব্রিটেনও যায়, ফ্রান্সও যায়, অন্য অনেক দেশই যায় । আমরা কাউকে সেখানে আসতে আমন্ত্রণ জানাই না ।" দক্ষিণ চিন সাগর এলাকায় ভারতও স্বাগত বলে জানিয়েছেন লোরেঞ্জানা । তবে পাশাপাশি তিনি সেখানে PLA-র সাম্প্রতিক নৌ-কার্যকলাপ নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন ।
এর আগেই অবশ্য গত মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট রডরিগো দুতার্তের মধ্যে টেলিফোনে এই বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল । সেখানে মোদি দুতার্তেকে বলেছিলেন, জাপানের পূর্ব উপকুল থেকে আফ্রিকার পূর্ব উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় ফিলিপিন্সকে ভারত তাদের একজন গুরুত্বপূর্ণ জোটসঙ্গী হিসাবেই দেখে ।
অ্যামেরিকা, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারতও একটি চতুর্ভূজীয় জোটের অন্তর্ভুক্ত, যারা চিনের এই আগ্রাসী অবস্থানের বিরুদ্ধে ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় শান্তি এবং স্থিতাবস্থা রক্ষার জন্য সচেষ্ট । সিং মনে করেন, যদিও দক্ষিণ চিন সাগর এলাকা ঘিরে ভারতের প্রত্যক্ষভাবে কিছু পাওয়ার নেই, তবু দিল্লি ওই এলাকা ঘিরে চিনের 'অতি আগ্রাসীট আচরণে উদ্বিগ্ন । তিনি বলেছেন, "ভারত (দক্ষিণ চিন সাগরে) কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হবে যদি চিন হিমালয়ের পার্বত্য এলাকায় নিজের স্বৈরাচারী চরিত্র অব্যাহত রাখে ।"