দিল্লি, 25 ফেব্রুয়ারি : "আমরা পাঁচ ঘণ্টা কাটিয়েছিলাম । আর মনে করা হচ্ছিল আমরা বলব, এই গ্রন্থাগারের জন্য ধন্যবাদ । আমি জানি না আফগানিস্তানে এই গ্রন্থাগার কারা ব্যবহার করবে ?"ভারতের আফগানিস্তানকে করা আর্থিক সাহায্যকে এভাবেই ব্যাঙ্গের সুরে 2019 সালে কটাক্ষ করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প । ভারতের এই আর্থিক সাহায্য ছিল ট্রাম্পের ভাষায়, "একটি গ্রন্থাগার তৈরির জন্য"। ভারতের সহযোগিতায় আফগানিস্তানে নবনির্মিত পার্লামেন্ট ভবনকে উদ্দেশ্য করেই সম্ভবত ট্রাম্প এই কথা বলেছিলেন । 2015 সালে এই পার্লামেন্ট ভবনকে গ্রন্থাগার ভবন হিসেবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি । যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশ আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের নিজের সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ট্রাম্প ওই মন্তব্য করেন ।
ট্রাম্পের এই মন্তব্যে দিল্লির তরফে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছিল । একইসঙ্গে জোরালো প্রতিক্রিয়ায় জানানো হয় যে, আফগানিস্তানকে ভারতের তরফে করা 3 বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থ সাহায্যের উদ্দেশ্য ছিল, দেশটির পুর্নগঠনে সাহায্য করার পূর্বপ্রতিশ্রুতি রক্ষা করা । পাশাপাশি এই সত্যটিও তুলে ধরা যে, অ্যামেরিকান বা পাকিস্তানিদের তুলনায় জনপ্রিয়তা এবং বিশ্বাসের মাপকাঠিতে স্থানীয় আফগানদের কাছে ভারত অনেকটাই এগিয়ে ।
আজ আহমেদাবাদের মোতেরায় বিশ্বের বৃহত্তম এবং নবীনতম ক্রিকেট স্টেডিয়াম ভরতি মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখলেন সেই ট্রাম্প । সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণ করার কথা বললেন । তবে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাঁর সুর ছিল নরম । # নমস্তে ট্রাম্প-এর বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমঞ্চে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে পাশে রেখে অ্যামেরিকার 45-তম প্রেসিডেন্ট বলেন, "সন্ত্রাসবাদী এবং সন্ত্রাসের মতার্দশ নির্মূল করার লড়াইয়ে অ্যামেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত একজোট হয়ে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ । এই কারণে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকেই আমি এবং আমার প্রশাসন পাকিস্তানের সঙ্গে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে কাজ করে আসছি যাতে পাক সীমান্ত এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকা জঙ্গি ও জঙ্গি সংগঠনগুলিকে ধ্বংস করা যায় ।"
2010 এবং 2015 সালে বারাক ওবামা যেমন করেছিলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের প্রথম একক ভারত সফরে তা কিন্তু করেননি ট্রাম্প । ভারত সফরের সঙ্গে তালিকায় পাক সফরও জুড়ে দেননি তিনি । কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারত সফরের জন্য ট্রাম্প যে সময়টিকে বেছে নিয়েছে তা গুরুত্বপূর্ণ । কারণ কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তানের সহযোগিতায় আমেরিকা-তালিবান "শান্তি চুক্তি"কার্যকর হবে । আর তাই ট্রাম্প নিজের ভাষণে বলেছেন, "পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো । তার জন্য সন্ত্রাস দমনে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের জন্য সেই দেশকে ধন্যবাদ । এরই ফলশ্রুতি হিসেবে সম্পর্কের এই উন্নতি হয়েছে । আমরা আশাবাদী, ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশেই উত্তেজনা হ্রাস পাবে । আরও বেশি স্থিতাবস্থা আসবে এবং শান্তি বিরাজ করবে ।"
বেঙ্গালুরুর তক্ষশিলা ইনস্টিটিউশনের গোয়েন্দা উপদেষ্টা তথা RAW-এর প্রাক্তন বিশেষ সচিব আনন্দ আর্নির কথায়, "ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগানিস্তান নিয়ে একটি চুক্তি চান । এটা তাঁর জন্য জরুরি । কারণ এটা তাঁকে পুর্ননির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে । 2020 সালের নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনা তাঁর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ । এর মাধ্যমে তিনি তাঁর দেওয়া অন্যতম প্রধান একটি প্রতিশ্রুতি পালনে সক্ষম হবেন ।" এটা সেই অন্যতম প্রধান চুক্তিরই প্রভাব । তাই 2018 সালের জানুয়ারি মাসে যে ট্রাম্প পাকিস্তানকে কার্যত হুঁশিয়ারি দিয়ে টুইট করেছিলেন, সেই তিনিই প্রথমে 2019 সালে হোয়াইট হাউজ়ে এবং পরে চলতি বছরের গোড়ায় দাভোসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে পাশে বসিয়ে "ভালো বন্ধু" বলে অভিহিত করেছেন ।
বৃত্তিগত কূটনীতিক এবং পাকিস্তানের প্রাক্তন হাই কমিশনার শরৎ সবরওয়ালের কথায়, "অ্যামেরিকা এবং পাকিস্তানের সম্পর্ক একান্তভাবেই লেনদেন নির্ভর । এক বছর ধরে অ্যামেরিকা পাকিস্তানের সাহায্য চেয়ে তাদের দিকে ঝুঁকে রয়েছে । স্পষ্টভাবেই শেষ পর্যন্ত এই চুক্তি আনার ক্ষেত্রে ইসলামাবাদ একটি বড় ধরনের ভূমিকা পালন করেছে । তাই এই চুক্তি বাস্তবায়িত হওয়ার আগে লক্ষ্যণীয়ভাবে শেষ শনিবার থেকে হিংসাও হ্রাস পেয়েছে । তাই গুজরাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যা বলেছেন, তাতে কেউই অবাক হয়নি ।" সবরওয়াল আরও বলেন, "একদিকে সন্ত্রাস দমন নিয়ে কড়া হতে অ্যামেরিকা পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করে আসছে । অন্যদিকে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের জন্য যতক্ষণ তাদের ইসলামাবাদের উপর নির্ভর করে থাকতে হচ্ছে, ততক্ষণ তারা পাকিস্তানের উপর খুব কঠোর কখনওই হবে না । ইতিমধ্যে অবশ্য প্রস্তাবিত শান্তি চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর পাকিস্তানের ভূমিকা কী হবে তা নিয়ে ভারতের উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে । কারণ যদি এর ফলে ভারতকে নিশানায় রাখা একাধিক জঙ্গি সংগঠন যেমন লস্কর-ই-তইবা, আফগান সীমান্ত থেকে তাদের প্রশিক্ষণ শিবিরগুলি সরিয়ে কাশ্মীরে নিয়ে আসে তাহলে তা চিন্তার কারণ বটে । আর এই শান্তি চুক্তি নিয়ে তার উদ্বেগের বিষয়টি দিল্লিতে ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনায় ভারত তুলতেও চলেছে । আর তা হচ্ছেও তখন, যখন আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আশরফ গনির নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কাবুলে লড়ছেন আবদুল্লা আবদুল্লা । এতে আরও বড় উদ্বেগ ঘনীভূত হতে পারে যদি অভ্যন্তরীণ এই রাজনৈতিক বিবাদের ফলে তালিবানের সঙ্গে ক্ষমতার বণ্টন নিয়ে "আন্তঃ-আফগান" আলোচনা আরও ভেস্তে যায় । এর মধ্যে দিল্লিকেও এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, ইসলামাবাদকে খুশি করতে ভবিষ্যতে আবার যেন ডোনাল্ড ট্রাম্প কাশ্মীর ইশুতে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব না দেন । এর আগেও কাশ্মীরকে একান্তভাবেই দ্বিপাক্ষিক বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করে বহুবার ভারত এই মধ্যস্থতার প্রস্তাব কড়াভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে ।