ডেঙ্গি…ডেঙ্গি…ডেঙ্গি
এই কথাটা ইদানীং প্রায় সবজায়গাতেই শোনা যায় । যখনই কেউ অসুস্থ হয়, আমরা আতঙ্কে ভুগি, তাঁর ডেঙ্গি হয়নি তো ? যদিও ডেঙ্গি একটি সাধারণ রোগ, তাহলে কেন সেটি এমন প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে ? আসলে এজন্য আমাদের সচেতনতার অভাবই দায়ি । কী কী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন ? রোগ কোন পর্যায়ে গেলে মনে করা উচিত যে সেটি বিপজ্জনক ? ডেঙ্গির কোন কোন পর্যায়ে কী কী ধরণের চিকিৎসার প্রয়োজন ? কীভাবে ডেঙ্গি প্রতিরোধ করা সম্ভব ? এই সমস্ত বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এই লেখায় ।
ভাইরাল ফিভার কী তা আমরা জানি । প্রতিবছরই ঋতু পরিবর্তনের সময় আমাদের অনেকের ভাইরাল ফিভার হয় । কিন্তু বিপজ্জনক হিসেবে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গি । এই ভাইরাল ফিভারটির প্রকোপ এখন সারা বছর ধরেই থাকে । সম্প্রতি প্রায় ৩.৩ কোটি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে । কিন্তু ১০ কোটির বেশি মানুষ ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হলেও তাদের মধ্যে রোগটির কোনও উপসর্গ দেখা যায়নি । আগে ডেঙ্গি শুধু শহরাঞ্চলের শিশুদের হত, কিন্তু এখন রোগটি সমস্ত অঞ্চলেই সববয়সীদের হচ্ছে । আগে যখন ডেঙ্গি হত, তখন রোগটির সাধারণ উপসর্গ যেমন, প্লেটলেট সংখ্যা কমে যাওয়া, রক্ত ঘন হয়ে যাওয়া, রক্তপাত ইত্যাদি রোগীর মধ্যে দেখা যেত । কিন্তু এখন অনেক ক্ষেত্রেই সেই সমস্ত উপসর্গ দেখা যায় না । ডেঙ্গি মস্তিষ্ক, যকৃৎ ও হৃদযন্ত্রের ক্ষতি করে গুরুতর সমস্যা তৈরি করছে । রোগটি চোখ ও হাড়ের সংযোগগুলিরও ক্ষতি করে । তবে ৯৮ শতাংশ ক্ষেত্রে ডেঙ্গি সাধারণ জ্বর হিসেবে এসে চলে যায় । রোগী বুঝতেও পারে না যে তার ডেঙ্গি হয়েছে । কিন্তু ১ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে ডেঙ্গি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে । যদি সঠিকভাবে চিকিৎসা করা হয় তবে সমস্যা দূর করা সম্ভব হবে । পাশাপাশি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে মশা যাতে না কামড়ায় সেদিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন ।
ডেঙ্গি এল কোথা থেকে?
ডেঙ্গির মূল কারণ হল ফ্লেভিভাইরাস । চার ধরণের ডেঙ্গি রয়েছে - ডেঙ্গি ১, ডেঙ্গি ২, ডেঙ্গি ৩, ডেঙ্গি ৪ । ডেঙ্গি ছড়ায় স্ত্রী ইডিস ইজিপ্টি মশার কামড়ের মাধ্যমে । যদি কোনও ব্যক্তির চার ধরনের মধ্যে কোনও এক ধরনের ডেঙ্গি হয়, তবে ভবিষ্যতে সে আর ওই ধরনের ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হবে না । কিন্তু অন্য ধরনের ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হতে পারে । অর্থাৎ তার মানে হল কোনও ব্যক্তি তার জীবদশ্শায় চার বার ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হতে পারে । কোনও ব্যক্তির দ্বিতীয়বার ডেঙ্গি হলে তা বেশি বিপজ্জনক ।
মশা কামড়ালেই কি ডেঙ্গি হয় ?
না, মশা কামড়ালেই ডেঙ্গি হয় না । যে মশার মধ্যে ডেঙ্গি ভাইরাস রয়েছে, সেই মশা কামড়ালে ডেঙ্গি হতে পারে । তবে ডেঙ্গির ভাইরাস শরীরে ঢুকলেই যে ডেঙ্গি হবে তার কোনও মানে নেই । কোনও ব্যক্তির ডেঙ্গি হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে ফের ডেঙ্গির ভাইরাস যদি তার শরীরে ঢোকে তবে অনেক ক্ষেত্রে তার ডেঙ্গি হয় না । কারণ কিছুদিন আগে ডেঙ্গি হওয়ার জন্য ওই ব্যক্তির শরীরে ডেঙ্গির সঙ্গে লড়াই করার জন্য অ্যান্টিবডি থাকে । সেটি ডেঙ্গির নতুন ভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে পারে । তা ছাড়া ডেঙ্গি হলেই রোগীর শরীরে তার জ্বরের উপসর্গ দেখা নাও দিতে পারে । মাত্র ১০ শতাংশ রোগীর জ্বর ও যাবতীয় উপসর্গ দেখা দেয় । অধিকাংশের ক্ষেত্রে মাত্র একটি-দুটো উপসর্গ দেখা দেয় যার মধ্যে রয়েছে মাথা ব্যথা ও হাড়ের যন্ত্রণা ।
হাসপাতালে কখন ভরতি করা উচিত ?
যখন রোগীর পেটে ব্যথা ও বমি হয়, পাকস্থলী ও ফুসফুসে জল জমে, ক্লান্তি আসে, যকৃৎ বড় হয়, তখন তাকে হাসপাতালে ভরতি করা উচিত । যদি রোগীর রক্তচাপ কমে যায়, অনিয়ন্ত্রিত রক্তপাত শুরু হয়, শরীরেক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিকল হতে শুরু করে (বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, জ্ঞান হারান ইত্যাদি) তখন দেরি না করে তাকে হাসপাতালে ভরতি করা উচিত । যাদের হাইপার টেনশন, আলসার, অ্যানিমিয়া রয়েছে তাদের এবং গর্ভবতী মহিলা, মেদবহুল ব্যক্তি, বয়স্ক ও এক বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গি গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে । তাই তাদের ডেঙ্গি হলে অবিলম্বে হাসপাতালে ভরতি করা উচিত ।
পরিস্থিতি অনুযায়ী চিকিৎসা করা উচিত
সাধারণ জ্বর হলে প্যারাসিটামল দিতে হবে । যদি বমি না হয়, তবে ORS দেওয়া প্রয়োজন । যদি বমি কমে তবে ORS চালিয়ে যাওয়া উচিত । শিশুদের ক্ষেত্রে বেশি যত্ন নেওয়া উচিত । তাদের ডেঙ্গি হলে অবিলম্বে হাসপাতালে ভরতি করা উচিত । প্লেটলেট কমে গেলে নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করা উচিত ও সেই অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত । যদি রোগী খেতে না পারে, রক্তচাপ কমে যায়, হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বেড়ে যায় তাহলে স্যালাইন দেওয়া উচিত । যদি ফুসফুসে ফ্লুইড জমে শ্বাসকষ্ট হয় রোগীকে ভেন্টিলেশনে রাখা উচিত । তবে পেটে ও বুকে ফ্লুইড জমলে তা বের করতে যাওয়া উচিত নয়, কারণ সেক্ষেত্রে রোগীর অত্যাধিক রক্তপাত হতে পারে । যদি রোগীর যকৃৎ বা হৃদযন্ত্র বিকল হতে শুরু করে তবে সেই অনুসারে চিকিৎসা করা উচিত ।
যদি গর্ভবতী মহিলাদের ডেঙ্গি হয়, তবে বিশেষ যত্ন নেওয়া উচিত । যেহেতু রক্তপাতের সম্ভাবনা থাকে, তাই সিজ়ারের বদলে সাধারণ পদ্ধতিতে প্রসব করানোর চেষ্টা করা উচিত ।
ডেঙ্গি রোগীর রক্ত ঘন হতে শুরু করলে তা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে ।
ডেঙ্গি রোগীর ক্ষেত্রে প্লেটলেট কমার থেকেও গুরুতর সমস্যা হল রক্ত ঘন হয়ে যাওয়া । এর কারণ হল ধমনী ও শিরা থেকে প্লাজমা বেরিয়ে যাওয়া ।
কখন হাসপাতাল থেকে রোগীকে ছাড়া উচিত ?
যখন কোনও ওষুধ ছাড়াই রোগীর টানা দু'দিন জ্বর না আসে ।
যখন রোগীর স্বাভাবিক ক্ষুধার উদ্রেক হয়
যখন রোগীর নাড়ির গতি, শ্বাস-প্রশ্বাস ও রক্তচাপ স্বাভাবিক হয়
যখন রোগীর প্রস্রাব স্বাভাবিক হয়
যখন রোগীর প্লেটলেটের সংখ্যা ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ বা তার বেশি থাকে ।
যখন স্যালাইন ছাড়াই রোগীর হেমাটোক্রিট লেভেল স্বাভাবিক হয়।
কতদিনে রোগী সুস্থ হয়ে উঠবে ?
জ্বর কমে গেলে রোগীর প্লেটলেটের সংখ্যা ৩-৫ দিনের মধ্যে বেড়ে যায় । তখন নাড়ির গতি, রক্তচাপ ও শ্বাস-প্রশ্বাসের হার তখন স্বাভাবিক হয়ে ওঠে । বমি, পেটে ব্যথা কমে যায় । স্বাভাবিক ক্ষুধার উদ্রেক হয় । প্রস্রাব স্বাভাবিক হয় । হিমোগ্লোবিনের মাত্রা স্বাভাবিক হলে বোঝা যায় যে জ্বর কমছে । অনেকের ক্ষেত্রে ত্বকে গুটি বের হয়, যেগুলি জ্বর কমার সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যায় এবং চুলকানি বাড়ে । কিন্তু এজন্য ভয় পাওয়ার কারণ নেই ।
একাধিক উপসর্গ
ডেঙ্গি ভাইরাস মশার কামড়ে ৩ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে ডেঙ্গির উপসর্গ দেখা দেয় । এক্ষেত্রে রোগের প্রাথমিক, গুরুতর ও সুস্থতার একাধিক পর্যায় রয়েছে । প্রাথমিক পর্যায়টি ৫ দিনের, গুরুতর পর্যায়টি ২-৩ দিনের হয় ।
প্রাথমিক পর্যায়
হঠাৎ জ্বর
মাথা ব্যথা
চোখে ব্যথা
বমি ও বমি-বমি ভাব
শরীরের বিভিন্ন অংশে ও হাড়ে যন্ত্রণা
খিদে কমে যাওয়া