পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

গণতন্ত্রের সম্পদ

By

Published : Nov 26, 2019, 5:38 PM IST

Updated : Nov 26, 2019, 6:20 PM IST

আধুনিক যুগে চাহিদার তুলনায় অনেকাংশে যোগান কমে যাওয়া, বেড়ে চলা জনসংখ্যা এবং সেই বিপুল জনসংখ্যার প্রয়োজন মানুষকে আরও স্বার্থপর করে তুলেছে । এর ফলে হিংসার ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে । এই ধরনের অনাচার রুখতে এবং সমাজের ভারসাম্য বজায় রাখতে নিয়ম কানুনের একটি সংক্ষিপ্ত রূপের খুবই প্রয়োজন । এই রূপেরই নাম সংবিধান ।

Democracy
গণতন্ত্রের সম্পদ

মনে করা হয়, বিশ্বের অন্য জীবের তুলনায় মানুষ অনেক যুক্তিসঙ্গত আচরণ করে । অপ্রয়োজনে অন্য জীবের ক্ষতি করে না, সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকতেই পছন্দ করে । কিন্তু, আধুনিক যুগে চাহিদার তুলনায় অনেকাংশে যোগান কমে যাওয়া, বেড়ে চলা জনসংখ্যা এবং সেই বিপুল জনসংখ্যার প্রয়োজন মানুষকে আরও স্বার্থপর করে তুলেছে । এর ফলে হিংসার ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে । এই ধরনের অনাচার রুখতে এবং সমাজের ভারসাম্য বজায় রাখতে নিয়ম কানুনের একটি সংক্ষিপ্ত রূপের খুবই প্রয়োজন । এই রূপেরই নাম সংবিধান ।

আধুনিক মানুষ আজ আর শুধু সামাজিক জীব নয়, সে একটি রাজনৈতিক বস্তুও বটে । একটা নির্দিষ্ট এলাকায় সমাজ হিসাবে বাস করার জন্য আমরা তৈরি করেছি রাষ্ট্র । এই রাষ্ট্র একটি সরকার ব্যবস্থা গঠন করে । গণতান্ত্রিক সরকারগুলির সাংবিধানিক অধিকার, বিচারব্যবস্থা, কার্যক্ষমতা, নাগরিকদের অধিকার ও দায়িত্ব- সব কিছুই সংবিধানের মধ্যে রক্ষিত থাকে । এটাই দেশের সর্বোচ্চ অধ্যাদেশ । সংবিধানই ঠিক করে দেয় শাসক ও প্রজার মধ্যে সম্পর্কের মাপকাঠি ।

সংবিধান হল রাষ্ট্রের মূল কাঠামো । গণতন্ত্রে সরকারে জনসাধারণের যোগদান, জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব, আমলাতন্ত্র এবং বিচারব্যবস্থার মতো বিষয়গুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । সংবিধানই এই বিষয়গুলিতে স্থিতিশীলতা আনে । গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হল সাংবিধানিক অখণ্ডতা ।

প্রধান উদ্দেশ্য

গণতন্ত্রে জনসাধারণই প্রজা এবং তারাই শাসক । সে ক্ষেত্রে সরকারকে নিয়ন্ত্রণে সংবিধানের প্রয়োজন আছে কি ? উত্তরটা অবশ্যই এবং সন্দেহাতীত ভাবে, হ্যাঁ । সংবিধানই পারে নিম্নলিখিত পাঁচটি প্রধান উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ করতে-

• সরকারের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ

• ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা

• নব্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আকস্মিক পরিবর্তন সহ্য করা ও নিয়ন্ত্রণ করা

• সমাজের পিছিয়ে থাকা অংশের উন্নতিসাধন

• সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ ও সমানাধিকার

এই সব উদ্দেশ্য সাধনে সংবিধানে বেশ কিছু রক্ষাকবচের ব্যবস্থা রয়েছে । সেগুলি হল-

সুরক্ষার যথাযথ অধিকার

ভারতের সংবিধান সরকারের কর্তৃত্বকে সীমাবদ্ধ রেখে দেশের নাগরিকদের স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারকে রক্ষা করে । সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের জন্য রাষ্ট্রকে নির্দেশ দেয় সংবিধানের বিভিন্ন নীতি । সংবিধানে উল্লিখিত ধর্মাচরণের স্বাধীনতার অধিকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির মধ্যে নিরাপত্তা প্রদান করে । ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়ে সরকারি হস্তক্ষেপকে নিয়ন্ত্রণ করে ধর্মনিরপেক্ষতা । সংবিধানের 17 নম্বর ধারা অস্পৃশ্যতাকে নিষিদ্ধ করেছে । এই আশ্বাসগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশের স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা ।

আধা-যুক্তরাষ্ট্র

ভারতীয় সংবিধান মার্কিন সংবিধানের থেকে অনুপ্রাণীত হলেও আমাদের সংবিধান প্রণেতারা একটি আধা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পক্ষপাতী । ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মীয় বিভিন্নতা ও দেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের একটা বড় অংশের বিচ্ছিন্নতাবাদী মানসিকতা একটি স্বতন্ত্র সাংবিধানিক ব্যবস্থার জন্য উৎসাহিত করেছে । এই আধা যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা কেন্দ্রে শক্তিশালী সরকার তৈরিতে সাহায্য করে । এই ব্যবস্থায় রাজ্য সরকারগুলিকে কেন্দ্রের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করতে হয় ।

সংসদীয় সরকার

সংবিধান প্রণেতারা রাষ্ট্রপতি ও সংসদীয় ব্যবস্থার স্থায়িত্বকে ভালো করে পরখ করে আমাদের দেশের জন্য সংসদীয় ব্যবস্থায় সম্মত হয়েছেন । সরকারে দেশের সর্বস্তর ও সর্বপ্রান্ত থেকে প্রতিনিধিত্ব রাখা হয়েছে, যাতে রাষ্ট্রপতির শাসনের ফলে হওয়া ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঠেকানো যায় । সর্বগ্রাসী শাসন ব্যবস্থার একমাত্র সমাধান হল সংসদীয় সরকার, যার মাধ্যমে রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সরকার খাপ খাইয়ে নিতে পারে । এমনকি, প্রয়োজনে সরকার পরিবর্তনও করা সম্ভব ।

সব আশা আকাঙ্খা কি পূর্ণ হয়েছে?

বিগত 70 বছর ধরে ভারতীয় সংবিধান কি দেশের নাগরিকদের আকাঙ্খা পূর্ণ করতে পেরেছে ? এর উত্তর একইসঙ্গে হ্যাঁ এবং না । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে স্বাধীনতা পাওয়া একাধিক দেশ গণতন্ত্র থেকে সর্বগ্রাসী শাসন ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে । যুগশ্লাভিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন, সুদানের মতো দেশ ভেঙে গিয়েছে । ভারত যে নিজের গণতন্ত্রকে সঠিকভাবে রক্ষা করতে পেরেছে, দেশের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করতে পেরেছে, তার একমাত্র কারণ দেশের শক্তিশালী সংবিধান । ভারতবর্ষ আজ বিশ্বে নিজের আলাদা জায়গা করতে সমর্থ হয়েছে । কিন্তু এই কথা অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই যে, দেশের সব মানুষের জীবন এখনও আরামপ্রদ নয়। ক্রমহ্রাসমান নৈতিক মূল্যবোধ, সঙ্কীর্ণতার বিস্তার, প্রাদেশিকতা, জাতপাত ও ভাষাভিত্তিক মতভেদ, অপরাধমূলক রাজনীতি বেড়েই চলেছে দেশ জুড়ে । দেশে সুবিধাবাদী রাজনীতি বেড়ে যাওয়ায় সন্দেহ হয়, এই দেশেরই স্বপ্ন গান্ধীজি দেখেছিলেন কি না । এর জন্য অবশ্য আমরা সবাই দায়ী । দেশের সর্বস্তর তাদের দায়িত্ব প্রতিপালনে ব্যর্থ হয়েছে । এই ব্যর্থতার জন্য তারা দেশের সংবিধানের দিকে আঙুল তুলছে । জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা, সমানাধিকার এবং উন্নতির স্বার্থে আমাদের প্রত্যকেরই দায়িত্ব আছে ।

ডঃ বি জে বি কৃপাদনম, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক

Last Updated : Nov 26, 2019, 6:20 PM IST

ABOUT THE AUTHOR

...view details