ETV Bharat / opinion

ভারতের দলত্যাগ বিরোধী আইনের দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা - Anti Defection Law

Anti Defection Law: দলবদল আটকাতে দলত্যাগ বিরোধী আইন রয়েছে ৷ তার পরও ভারতীয় রাজনীতিতে দলত্যাগকে জলভাত বানিয়ে ফেলেছেন নেতারা ৷ তাহলে কি দলত্যাগ বিরোধী আইন কার্যকারিত হারাচ্ছে ? সমস্যা কোথায় ? লিখেছেন ঋতিকা শর্মা ৷

West Bengal Assembly
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা (নিজস্ব চিত্র)
author img

By Ritwika Sharma

Published : May 15, 2024, 6:06 AM IST

নয়াদিল্লি, 15 মে: ভারতীয় রাজনীতিতে দলবদল এখন নেতাদের কাছে জলভাত হয়ে গিয়েছে ৷ মধ্যপ্রদেশ-গুজরাত সহ একাধিক রাজ্যে দলবদলের ঘটনা প্রায়ই দেখা যায় ৷ সম্প্রতি সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছেন হরিয়ানার তিন নির্দল বিধায়ক ৷ ঘন ঘন দলবদল নিয়ে যে রাজ্য থেকে ‘আয়া রাম, গয়া রাম’ কথাটির উৎপত্তি, সেই রাজ্যের ওই তিন নির্দল বিধায়ক হরিয়ানায় মুখ্যমন্ত্রী নয়াব সিং সাইনির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের সঙ্গে ছিলেন ৷ কিন্তু তাঁরা সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে কংগ্রেসকে সমর্থনের কথা জানান ৷

যদিও ভারতে দলত্যাগ বিরোধী আইন আছে ৷ যা ভারতের সংবিধানের দশম তফসিলের অধীনে 1985 সালে সংসদ এবং রাজ্য বিধানসভাগুলিতে পাশ করিয়ে আইনে পরিণত করা হয় ৷ কিন্তু তা কার্যত নীরব দর্শক হয়েই রয়ে গিয়েছে ৷ 2002 সালে সংবিধানের কার্যকারিতা পর্যালোচনা করার জন্য তৈরি জাতীয় কমিশন এই নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছিল ৷ তারা জানিয়েছিল যে এই আইন তৈরি হওয়ার পর আরও বেশি সংখ্যক দলত্যাগের ঘটনা ঘটেছে ৷ স্বাভাবিকভাবেই তাই প্রশ্ন উঠেছে যে কেন এই পরিস্থিতি তৈরি হল ?

আইনে শাস্তির কী ব্য়বস্থা রয়েছে এবং কোন কোন দিকগুলিতে এখনও ছাড় দেওয়া রয়েছে ?

দশম তফসিলের অনেক ত্রুটির কারণে এই আইনের খসড়া তৈরিতে বেশ কিছু ফাঁক থেকে গিয়েছে ৷ বিশেষ করে একসঙ্গে অনেকে দল ছাড়লে এই বিষয়টি বেশি করে স্পষ্ট হয় ৷ যখন কেউ স্বেচ্ছায় দল ছাড়েন কিংবা সংসদ বা রাজ্য বিধানসভায় দলের নির্দেশ উপেক্ষা করে বিরুদ্ধে ভোট দেন, তাহলে দশম তফসিল অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিধায়কের সদস্যপদ খারিজ হয়ে যায় ৷ তাছাড়া নির্দল সাংসদ বা বিধায়করা নির্বাচনের পরে কোনও রাজনৈতিক দলে যোগ দিলে তাঁদের সদস্যপদ খারিজ হয়ে যায় ৷ তবে সদস্যপদ খারিজ হওয়ার পুরো বিষয়টি নির্ভর করে বিধানসভা বা লোকসভার অধ্যক্ষ কিংবা রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের উপর ৷

দলত্যাগ বিরোধী আইনে দু’টি ব্যতিক্রমেরও উল্লেখ রয়েছে ৷ তার মধ্যে একটি হল, কোনও একটি দল ভাগ হয়ে যাওয়া নিয়ে ৷ আর অন্যটি হল দু’টি দল মিশে যাওয়া নিয়ে ৷ এই নিয়ে যে সংসদীয় বিতর্কগুলি হয়েছে, সেখানে স্পষ্ট করা হয়েছে যে আইনে এই ব্যতিক্রম রাখার উদ্দেশ্য ছিল কোনও জনপ্রতিনিধি ও তাঁর দলের মধ্যে নীতিগত বিরোধ তৈরি হলে কী হবে, সেই পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ৷ উদ্দেশ্য মহৎ ছিল৷ কিন্তু এখন তা ব্যবহার করা হয় কারও কারও সুবিধার জন্য ৷ কৌশলে সরকার ফেলার জন্য এই আইনের বহু ব্য়বহারে 2003 সালে এই আইন থেকে একটি দল ভাগ হওয়া সংক্রান্ত বিষয়টি সরিয়ে দেওয়া হয় ৷

সংযুক্তিকরণের ব্যতিক্রম অবশ্য রয়ে গিয়েছে । দশম তফসিলের অনুচ্ছেদ 4-এর অধীনে পাওয়া গিয়েছে, সংযুক্তিকরণের বিষয়টি দু’টি উপ-অনুচ্ছেদ জুড়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে । এই দু’টি উপ-অনুচ্ছেদের একসঙ্গে পড়লে দেখা যাবে যে একজন জনপ্রতিনিধি অযোগ্যতা থেকে অব্যাহতি দাবি করতে পারেন, যদি তিনি একই সঙ্গে দু’টি শর্ত পূরণ করতে পারেন ৷ প্রথমত, কোনও জনপ্রনিধির মূল রাজনৈতিক দল যদি অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিশে যায় ৷ দ্বিতীয়ত, কোনও দলের পরিষদীয় বা সংসদীয় দলের দুই তৃতীয়াংশ সদস্য যদি অন্য দলে যোগদান করেন ৷

কিন্তু সংযুক্তিকরণের বিষয়টি বেশ জটিল ৷ এই আইনের জটিলতা একাধিকবার কোনও সদনের অধ্যক্ষ বা আদালত দ্বারাও ব্যাখ্যা করা হয়েছে ৷ বেশ কয়েকটি হাইকোর্ট এই নিয়ে যে ব্য়াখ্যাটি দিয়েছে, তা হল - একটি নির্দিষ্ট পরিষদীয় বা সংসদীয় দলের দুই-তৃতীয়াংশ যখন অন্য একটি দলের সঙ্গে মিশে যেতে সম্মত হয়, তখনই দুই পরিষদীয় দলের সংযুক্তিকরণ হয়েছে বলে ধরা হয় ৷ এই ধরনের ব্যাখ্যার জন্য জাতীয় বা আঞ্চলিক স্তরে মূল রাজনৈতিক দলগুলির বাস্তবসম্মত সংযুক্তিকরণের প্রয়োজন হয় না ।

একই সঙ্গে অনেকে দলত্যাগ করলে কিভাবে সংযুক্তকরণের বিষয়টি প্রযোজ্য় হবে ?

আপাতদৃষ্টিতে জটিল এই আইনি বিষয়টি আইনসভার ভিতরে ও বাইরে রাজনৈতিক দলগুলির কাজের উপর প্রভাব ফেলে । সংশ্লিষ্ট দলকে দেখাতে হবে যে কেবলমাত্র আইনসভার অন্দরেই দলগুলি একত্রীভূত হয়েছে, বাইরে নয় ৷ সুষ্ঠভাবে সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে, সেটাও দেখাতে হবে৷ উদারহণ হিসেবে 2019 সালে গোয়া বিধানসভার ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে ৷ সেই সময় ওই রাজ্যে কংগ্রেসের 15 জন বিধায়কের মধ্যে 10 জন বিজেপিতে যোগদান করেছিলেন ৷ ফলে কংগ্রেস বিধায়কদের পদ থেকে গিয়েছিল ৷ বিধানসভার অধ্যক্ষও তাঁদের পদ খারিজের আবেদন খারিজ করে দিয়েছিলেন ৷ সেই সিদ্ধান্তকে বহাল রাখে বম্বে হাইকোর্টের গোয়া বেঞ্চও ৷

আইনসভার অন্দরের যেহেতু দু’টি দল মিশে যাওয়ার প্রমাণের প্রয়োজন হয়, তাই পরিবর্তে একসঙ্গে অনেক বিধায়কের দলত্যাগ অনেক সহজ হয়েছে ৷ খুব স্বাভাবিকভাবেই এক্ষেত্রে দলত্যাগ বিরোধী আইনে দলত্যাগী বিধায়কদের অযোগ্য না হওয়ার প্রাথমিক কারণ হল সংযুক্তকরণ ও দু’টি দলে ভাগ হয়ে যাওয়া ৷ দ্য বিধি সেন্টার ফর লিগাল পলিসি (বিধি) 1986 থেকে 2004 সালের মধ্যে লোকসভার স্পিকারদের কাছে জমা পড়া 55টি অযোগ্যতার পিটিশনের একটি সমীক্ষা করে দেখেছে ৷ এই পিটিশনগুলির মধ্যে 49টি ক্ষেত্রে কোনও সাংসদকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়নি ৷ যদিও তারা অন্য দলে চলে যায় ৷ এর মধ্যে 77 শতাংশ ক্ষেত্রে (49টির মধ্যে 38টি) দলত্যাগী সাংসদদের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়নি, কারণ তাঁরা তাঁদের মূল দলের বৈধ বিভাজন বা অন্য দলের সঙ্গে সংযুক্তিকরণের বিষয়ে প্রমাণ দিতে পারে ৷ উত্তরপ্রদেশ থেকেও অনুরূপ তথ্য পাওয়া গিয়েছে ৷ সেখানে 1990 থেকে 2008-এর মধ্যে বিধায়ক পদ খারিজের 69টি আবেদন জমা পড়ে ৷ এর মধ্য়ে মাত্র দু’টি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিধায়ককে অযোগ্য বলে ঘোষণা করে পদ খারিজ করে দেওয়া হয় ৷ বাকি 67টির মধ্যে 55টি (প্রায় 82 শতাংশ) ক্ষেত্রে সংযুক্তিকরণ ও বিভাজন পদ খারিজ না করার কারণ হিসেবে সামনে এসেছে ৷

দলত্যাগ বিরোধী আইন কি ভালো ?

নির্দল বিধায়ক ও সাংসদদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে এই দলত্যাগ বিরোধী আইন কিছুটা হলেও সাফল্য পেয়েছে ৷ বিধির তরফে সমীক্ষা করে দিয়েছে 1989 সাল থেকে 2011 সাল পর্যন্ত হরিয়ানায় পদ খারিজের জন্য 39টি আবেদন জমা পড়ে৷ 12 জনের পদ খারিজ করে দেন হরিয়ানা বিধানসভার অধ্যক্ষ ৷ এঁদের মধ্যে ন’জন নির্দল বিধায়ক ছিলেন ৷ এর মধ্যে 2004 সালে 6 জন নির্দল বিধায়কের পদ খারিজ করে দেন হরিয়ানা বিধানসভার অধ্যক্ষ সতবীর সিং কাডিয়ান ৷ রাজ্যসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেসে যোগ দেওয়ায় তাঁদের পদ খারিজ হয়ে যায় ৷

মেঘালয়ে 1988 থেকে 2009 সালের মধ্যে 18 জন বিধায়কের পদ খারিজের আবেদন জমা পড়ে ৷ এর মধ্যে পাঁচজন নির্দল বিধায়ককে একটি রাজনৈতিক দলে যোগদানের জন্য অযোগ্য বলে ঘোষণা করা হয় ৷

2009 সালের 8 থেকে 9 এপ্রিলের মধ্যে পরপর তিনটি ঘটনা ঘটেছিল, যখন নির্দল বিধায়ক পল লিংডোহ, ইসমাইল আর মারাক এবং লিমিসন ডি সাংমার বিধায়ক পদ খারিজ করা হয় ৷ কারণ, তাঁরা অন্য রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়েছিলেন ৷ লিংডোহ কংগ্রেসে, ইসমাইল ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক পার্টিতে এবং সাংমা এনসিপি-তে যোগ দিয়েছিলেন । তাঁদের সকলকে তৎকালীন স্পিকার বিন্দো এম ল্যানং অযোগ্য ঘোষণা করেছিলেন ৷ নির্বাচনের পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে উপহাসের পাত্র করায় ওই বিধায়কদের ভর্ৎসনাও করেছিলেন স্পিকার ৷

দশম তফসিলের কী ভবিষ্যৎ আছে ?

সমস্ত রাজ্যের বিধানসভাগুলির অধ্যক্ষদের নেওয়া সিদ্ধান্তগুলি সম্পর্কে তথ্য তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে (ইংরেজি ছাড়া) সহজে পাওয়া যায় না, যা দশম তফসিলের একটি ব্যাপক মূল্যায়নে বাধা হচ্ছে ৷ যাই হোক, এটা বলা নিরাপদ যে আইনের সাফল্যগুলিকে গণনা করা হয়েছে এবং এটি অনেকাংশে অকার্যকর রয়ে গিয়েছে । এই বছরের শুরুতে অল ইন্ডিয়া প্রিসাইডিং অফিসারদের সম্মেলনে এই আইনের পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল । আশা করা যায়, এই কমিটি দশম তফসিলের কার্যকারিতার একটি বিস্তৃত পর্যালোচনা করবে এবং ভারতকে এমন একটি দলত্যাগ বিরোধী আইন দেবে, যা সংসদীয় গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাবে ।

আরও পড়ুন:

  1. অন্ধ্রপ্রদেশে নৈরাজ্যবাদের সমাপ্তি: একটি ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা
  2. কীভাবে শুরু আস্থা ভোট ও ভারতীয় রাজনীতিতে কোন পথে এগিয়ে চলেছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের এই পরীক্ষা ?
  3. লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগের ফসল সংবিধান রক্ষাই আসল চ্যালেঞ্জ

নয়াদিল্লি, 15 মে: ভারতীয় রাজনীতিতে দলবদল এখন নেতাদের কাছে জলভাত হয়ে গিয়েছে ৷ মধ্যপ্রদেশ-গুজরাত সহ একাধিক রাজ্যে দলবদলের ঘটনা প্রায়ই দেখা যায় ৷ সম্প্রতি সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছেন হরিয়ানার তিন নির্দল বিধায়ক ৷ ঘন ঘন দলবদল নিয়ে যে রাজ্য থেকে ‘আয়া রাম, গয়া রাম’ কথাটির উৎপত্তি, সেই রাজ্যের ওই তিন নির্দল বিধায়ক হরিয়ানায় মুখ্যমন্ত্রী নয়াব সিং সাইনির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের সঙ্গে ছিলেন ৷ কিন্তু তাঁরা সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে কংগ্রেসকে সমর্থনের কথা জানান ৷

যদিও ভারতে দলত্যাগ বিরোধী আইন আছে ৷ যা ভারতের সংবিধানের দশম তফসিলের অধীনে 1985 সালে সংসদ এবং রাজ্য বিধানসভাগুলিতে পাশ করিয়ে আইনে পরিণত করা হয় ৷ কিন্তু তা কার্যত নীরব দর্শক হয়েই রয়ে গিয়েছে ৷ 2002 সালে সংবিধানের কার্যকারিতা পর্যালোচনা করার জন্য তৈরি জাতীয় কমিশন এই নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছিল ৷ তারা জানিয়েছিল যে এই আইন তৈরি হওয়ার পর আরও বেশি সংখ্যক দলত্যাগের ঘটনা ঘটেছে ৷ স্বাভাবিকভাবেই তাই প্রশ্ন উঠেছে যে কেন এই পরিস্থিতি তৈরি হল ?

আইনে শাস্তির কী ব্য়বস্থা রয়েছে এবং কোন কোন দিকগুলিতে এখনও ছাড় দেওয়া রয়েছে ?

দশম তফসিলের অনেক ত্রুটির কারণে এই আইনের খসড়া তৈরিতে বেশ কিছু ফাঁক থেকে গিয়েছে ৷ বিশেষ করে একসঙ্গে অনেকে দল ছাড়লে এই বিষয়টি বেশি করে স্পষ্ট হয় ৷ যখন কেউ স্বেচ্ছায় দল ছাড়েন কিংবা সংসদ বা রাজ্য বিধানসভায় দলের নির্দেশ উপেক্ষা করে বিরুদ্ধে ভোট দেন, তাহলে দশম তফসিল অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিধায়কের সদস্যপদ খারিজ হয়ে যায় ৷ তাছাড়া নির্দল সাংসদ বা বিধায়করা নির্বাচনের পরে কোনও রাজনৈতিক দলে যোগ দিলে তাঁদের সদস্যপদ খারিজ হয়ে যায় ৷ তবে সদস্যপদ খারিজ হওয়ার পুরো বিষয়টি নির্ভর করে বিধানসভা বা লোকসভার অধ্যক্ষ কিংবা রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের উপর ৷

দলত্যাগ বিরোধী আইনে দু’টি ব্যতিক্রমেরও উল্লেখ রয়েছে ৷ তার মধ্যে একটি হল, কোনও একটি দল ভাগ হয়ে যাওয়া নিয়ে ৷ আর অন্যটি হল দু’টি দল মিশে যাওয়া নিয়ে ৷ এই নিয়ে যে সংসদীয় বিতর্কগুলি হয়েছে, সেখানে স্পষ্ট করা হয়েছে যে আইনে এই ব্যতিক্রম রাখার উদ্দেশ্য ছিল কোনও জনপ্রতিনিধি ও তাঁর দলের মধ্যে নীতিগত বিরোধ তৈরি হলে কী হবে, সেই পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ৷ উদ্দেশ্য মহৎ ছিল৷ কিন্তু এখন তা ব্যবহার করা হয় কারও কারও সুবিধার জন্য ৷ কৌশলে সরকার ফেলার জন্য এই আইনের বহু ব্য়বহারে 2003 সালে এই আইন থেকে একটি দল ভাগ হওয়া সংক্রান্ত বিষয়টি সরিয়ে দেওয়া হয় ৷

সংযুক্তিকরণের ব্যতিক্রম অবশ্য রয়ে গিয়েছে । দশম তফসিলের অনুচ্ছেদ 4-এর অধীনে পাওয়া গিয়েছে, সংযুক্তিকরণের বিষয়টি দু’টি উপ-অনুচ্ছেদ জুড়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে । এই দু’টি উপ-অনুচ্ছেদের একসঙ্গে পড়লে দেখা যাবে যে একজন জনপ্রতিনিধি অযোগ্যতা থেকে অব্যাহতি দাবি করতে পারেন, যদি তিনি একই সঙ্গে দু’টি শর্ত পূরণ করতে পারেন ৷ প্রথমত, কোনও জনপ্রনিধির মূল রাজনৈতিক দল যদি অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিশে যায় ৷ দ্বিতীয়ত, কোনও দলের পরিষদীয় বা সংসদীয় দলের দুই তৃতীয়াংশ সদস্য যদি অন্য দলে যোগদান করেন ৷

কিন্তু সংযুক্তিকরণের বিষয়টি বেশ জটিল ৷ এই আইনের জটিলতা একাধিকবার কোনও সদনের অধ্যক্ষ বা আদালত দ্বারাও ব্যাখ্যা করা হয়েছে ৷ বেশ কয়েকটি হাইকোর্ট এই নিয়ে যে ব্য়াখ্যাটি দিয়েছে, তা হল - একটি নির্দিষ্ট পরিষদীয় বা সংসদীয় দলের দুই-তৃতীয়াংশ যখন অন্য একটি দলের সঙ্গে মিশে যেতে সম্মত হয়, তখনই দুই পরিষদীয় দলের সংযুক্তিকরণ হয়েছে বলে ধরা হয় ৷ এই ধরনের ব্যাখ্যার জন্য জাতীয় বা আঞ্চলিক স্তরে মূল রাজনৈতিক দলগুলির বাস্তবসম্মত সংযুক্তিকরণের প্রয়োজন হয় না ।

একই সঙ্গে অনেকে দলত্যাগ করলে কিভাবে সংযুক্তকরণের বিষয়টি প্রযোজ্য় হবে ?

আপাতদৃষ্টিতে জটিল এই আইনি বিষয়টি আইনসভার ভিতরে ও বাইরে রাজনৈতিক দলগুলির কাজের উপর প্রভাব ফেলে । সংশ্লিষ্ট দলকে দেখাতে হবে যে কেবলমাত্র আইনসভার অন্দরেই দলগুলি একত্রীভূত হয়েছে, বাইরে নয় ৷ সুষ্ঠভাবে সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে, সেটাও দেখাতে হবে৷ উদারহণ হিসেবে 2019 সালে গোয়া বিধানসভার ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে ৷ সেই সময় ওই রাজ্যে কংগ্রেসের 15 জন বিধায়কের মধ্যে 10 জন বিজেপিতে যোগদান করেছিলেন ৷ ফলে কংগ্রেস বিধায়কদের পদ থেকে গিয়েছিল ৷ বিধানসভার অধ্যক্ষও তাঁদের পদ খারিজের আবেদন খারিজ করে দিয়েছিলেন ৷ সেই সিদ্ধান্তকে বহাল রাখে বম্বে হাইকোর্টের গোয়া বেঞ্চও ৷

আইনসভার অন্দরের যেহেতু দু’টি দল মিশে যাওয়ার প্রমাণের প্রয়োজন হয়, তাই পরিবর্তে একসঙ্গে অনেক বিধায়কের দলত্যাগ অনেক সহজ হয়েছে ৷ খুব স্বাভাবিকভাবেই এক্ষেত্রে দলত্যাগ বিরোধী আইনে দলত্যাগী বিধায়কদের অযোগ্য না হওয়ার প্রাথমিক কারণ হল সংযুক্তকরণ ও দু’টি দলে ভাগ হয়ে যাওয়া ৷ দ্য বিধি সেন্টার ফর লিগাল পলিসি (বিধি) 1986 থেকে 2004 সালের মধ্যে লোকসভার স্পিকারদের কাছে জমা পড়া 55টি অযোগ্যতার পিটিশনের একটি সমীক্ষা করে দেখেছে ৷ এই পিটিশনগুলির মধ্যে 49টি ক্ষেত্রে কোনও সাংসদকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়নি ৷ যদিও তারা অন্য দলে চলে যায় ৷ এর মধ্যে 77 শতাংশ ক্ষেত্রে (49টির মধ্যে 38টি) দলত্যাগী সাংসদদের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়নি, কারণ তাঁরা তাঁদের মূল দলের বৈধ বিভাজন বা অন্য দলের সঙ্গে সংযুক্তিকরণের বিষয়ে প্রমাণ দিতে পারে ৷ উত্তরপ্রদেশ থেকেও অনুরূপ তথ্য পাওয়া গিয়েছে ৷ সেখানে 1990 থেকে 2008-এর মধ্যে বিধায়ক পদ খারিজের 69টি আবেদন জমা পড়ে ৷ এর মধ্য়ে মাত্র দু’টি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিধায়ককে অযোগ্য বলে ঘোষণা করে পদ খারিজ করে দেওয়া হয় ৷ বাকি 67টির মধ্যে 55টি (প্রায় 82 শতাংশ) ক্ষেত্রে সংযুক্তিকরণ ও বিভাজন পদ খারিজ না করার কারণ হিসেবে সামনে এসেছে ৷

দলত্যাগ বিরোধী আইন কি ভালো ?

নির্দল বিধায়ক ও সাংসদদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে এই দলত্যাগ বিরোধী আইন কিছুটা হলেও সাফল্য পেয়েছে ৷ বিধির তরফে সমীক্ষা করে দিয়েছে 1989 সাল থেকে 2011 সাল পর্যন্ত হরিয়ানায় পদ খারিজের জন্য 39টি আবেদন জমা পড়ে৷ 12 জনের পদ খারিজ করে দেন হরিয়ানা বিধানসভার অধ্যক্ষ ৷ এঁদের মধ্যে ন’জন নির্দল বিধায়ক ছিলেন ৷ এর মধ্যে 2004 সালে 6 জন নির্দল বিধায়কের পদ খারিজ করে দেন হরিয়ানা বিধানসভার অধ্যক্ষ সতবীর সিং কাডিয়ান ৷ রাজ্যসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেসে যোগ দেওয়ায় তাঁদের পদ খারিজ হয়ে যায় ৷

মেঘালয়ে 1988 থেকে 2009 সালের মধ্যে 18 জন বিধায়কের পদ খারিজের আবেদন জমা পড়ে ৷ এর মধ্যে পাঁচজন নির্দল বিধায়ককে একটি রাজনৈতিক দলে যোগদানের জন্য অযোগ্য বলে ঘোষণা করা হয় ৷

2009 সালের 8 থেকে 9 এপ্রিলের মধ্যে পরপর তিনটি ঘটনা ঘটেছিল, যখন নির্দল বিধায়ক পল লিংডোহ, ইসমাইল আর মারাক এবং লিমিসন ডি সাংমার বিধায়ক পদ খারিজ করা হয় ৷ কারণ, তাঁরা অন্য রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়েছিলেন ৷ লিংডোহ কংগ্রেসে, ইসমাইল ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক পার্টিতে এবং সাংমা এনসিপি-তে যোগ দিয়েছিলেন । তাঁদের সকলকে তৎকালীন স্পিকার বিন্দো এম ল্যানং অযোগ্য ঘোষণা করেছিলেন ৷ নির্বাচনের পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে উপহাসের পাত্র করায় ওই বিধায়কদের ভর্ৎসনাও করেছিলেন স্পিকার ৷

দশম তফসিলের কী ভবিষ্যৎ আছে ?

সমস্ত রাজ্যের বিধানসভাগুলির অধ্যক্ষদের নেওয়া সিদ্ধান্তগুলি সম্পর্কে তথ্য তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে (ইংরেজি ছাড়া) সহজে পাওয়া যায় না, যা দশম তফসিলের একটি ব্যাপক মূল্যায়নে বাধা হচ্ছে ৷ যাই হোক, এটা বলা নিরাপদ যে আইনের সাফল্যগুলিকে গণনা করা হয়েছে এবং এটি অনেকাংশে অকার্যকর রয়ে গিয়েছে । এই বছরের শুরুতে অল ইন্ডিয়া প্রিসাইডিং অফিসারদের সম্মেলনে এই আইনের পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল । আশা করা যায়, এই কমিটি দশম তফসিলের কার্যকারিতার একটি বিস্তৃত পর্যালোচনা করবে এবং ভারতকে এমন একটি দলত্যাগ বিরোধী আইন দেবে, যা সংসদীয় গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাবে ।

আরও পড়ুন:

  1. অন্ধ্রপ্রদেশে নৈরাজ্যবাদের সমাপ্তি: একটি ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা
  2. কীভাবে শুরু আস্থা ভোট ও ভারতীয় রাজনীতিতে কোন পথে এগিয়ে চলেছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের এই পরীক্ষা ?
  3. লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগের ফসল সংবিধান রক্ষাই আসল চ্যালেঞ্জ
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.